অস্থির সমাজে অর্থনীতিও সুস্থির থাকে না

অস্থির সমাজে অর্থনীতিও সুস্থির থাকে না

ড. আতিউর রহমানের জন্ম ১৯৫১ সালে জামালপুর জেলায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং অর্থনীতিবিদ হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও তিনি মূলত লেখক। রবীন্দ্রনাথের ওপর গবেষণার জন্য পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’। রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তা এবং বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক নানা পরিকল্পনার ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য পাঠকহৃদয় জয় করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান। সেখান থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। অর্থনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে ‘পূর্বা’র পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা হয়। সেই আলোচনার অংশবিশেষ পত্রস্থ হলো। বি. স।

আপনি তো শুধু অর্থনীতিবিদ না, লেখকও। আপনার গবেষণা আপনার লেখালেখি এটা আমরা আপনার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নানাভাবে দেখেছি, যখন আপনি গভর্নর ছিলেন। আপনি প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে কাজ করেছেন। দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন; যেটা ওই সময় প্রশংসিত হয়েছিল। শেক্সপিয়ার বলেছিলেন অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায় ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেক্সপিয়ারের এই উক্তিকে কীভাবে দেখবেন ?

ড. আতিউর রহমান: আসলে শেক্সপিয়ার যখন বলেছিলেন তখন ইংল্যান্ডে বা পশ্চিমে দারিদ্র্য প্রকট ছিল এবং একই সঙ্গে অভিজাতদের প্রতাপ ছিল প্রবল। আর বৈষম্য ছিল অনেক দৃষ্টিকটু। সে রকম সময়ে শেক্সপিয়ার অনেক লেখা লিখেছেন যেখানে গরিবদের কথা, সাধারণের কথা বেশি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে ভূ-স্বামীদের বা আভিজাত্যের অন্দরমহলের নানা কথাও তিনি লিখেছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও সে রকমটি দেখতে পাই। দুই বিঘা জমির মধ্যে আমরা উপেনের যে কষ্টের কথা দেখতে পাই সেখান থেকে বোঝা যায় দারিদ্র্য বিষয়টি অনেক বেশি অমানবিকও বটে। এ কারণেই তিনি মনে করতেন যে মানুষ শুধু অর্থের অভাবের জন্য দরিদ্র হয় না। দারিদ্র্য মানুষের মানসিক সক্ষমতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। মানুষ তখন সংকুচিত হয়। আরও দিশেহারা হয়ে যায়।

আর দারিদ্র্য আসলে বহুমাত্রিক একটা বিষয়। আমরা অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে খেয়াল করেছি, স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু আমাদের এই যে পিছিয়ে পড়া জনগণ কৃষক-প্রজা তাদের জন্য আন্দোলন করেছেন। তিনি আজীবন বৈষম্যের অর্থনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর ছয় দফা কিংবা দুই অর্থনীতির যে আন্দোলন সেখানেও কিন্তু সাধারণ মানুষই ছিলেন কেন্দ্রে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এলো। সেখানেও সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা তিনি বেশি করে ভেবেছেন। ঐ পরিকল্পনার মোট বিনিয়োগের ২৪% তিনি কৃষির উন্নয়নের জন্য রেখেছিলেন। কিন্তু তাতেও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারপর এলো দ্বিতীয় বিপ্লব। দ্বিতীয় বিপ্লবে তিনি সমবায় এবং সংগঠিত মানুষকে সামনে নিয়ে এলেন। পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি যে, কী করে বাংলাদেশটা আবার বৈষম্যের শিকার হলো। সাধারণ মানুষ আবার প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেল। তার পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বৈষম্য কমেনি। বরং বৈষম্য বেড়েই চলেছে। সেই জন্য আমরা চেষ্টা করেছি, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে উন্নয়নমুখী করার জন্য। আমরা বরাবরই কৃষকের কথা, গরিবের কথা, নারীদের কথা অনেকবার বলেছি। কী করে তাদের হাতে কিছু অর্থ দেয়া যায়, তাদের হাতে সক্ষমতা দেয়া যায়; সেই চেষ্টা আমরা করেছি। এখনও করে যাচ্ছি।

আমি মনে করি যে, দারিদ্র্যের এই চ্যালেঞ্জিং বিষয়টি শুধু ব্যাংক খাত একা সামাল দিতে পারবে না। এর জন্য দরকার পুরো সমাজ-রাজনীতি ও সংস্কৃতির মন বদল। সবারই একটা ঐকমত্য দরকার যে, যারা পেছনে পড়ে আছে আমরা তাদের সামনে নিয়ে আসব। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহে এই কথাটাই বড় করে এসেছে। পেছনে পড়া মানুষগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে হবে বলে জাতিসংঘও গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজে এবং অর্থনীতিতে এখন পর্যন্ত মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে বেশিরভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে না, আমেরিকান সোসাইটিতে এই বৈষম্য আরো বেশি। টমাস পিকেটি ক্যাপিটালিজমের ওপর যে বইটি লিখেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন মানুষের হাতে সারা বিশ্বের সম্পদ জমা হচ্ছে। আর এরাই কম সুদে জামানতবিহীন বেশি করে ঋণ পাচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আমরা আশা করেছিলাম এই কতিপয়তন্ত্রের অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। যতটুকু সম্ভব একটি মানবিক ব্যাংকিং চালু করার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। ওপরের দিকে হয়তো আমরা খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে। কিন্তু নিচের দিকের মানুষদের যদি সক্ষমতার মানদন্ডে একটু ওপরে তুলে আনতে পারি, কৃষকদের যদি আরও একটু সুযোগ দিতে পারি, যারা বর্গাচাষি তাদের জন্য যদি একটু সুযোগ বাড়াতে পারি তাহলে অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতির ভিত্তি জোরদার করা সম্ভব বলে আমরা মনে করেছি। সেই চেষ্টাগুলো করেছি। আমরা এখনো মনে করি যে, এদের দিকে একটু নজর বেশি দিলে আসলে সার্বিকভাবে অর্থনীতির আকারটা বাড়ে এবং শুধু আকার বাড়াই না, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ে, ভোগ বাড়ে এবং অর্থনীতিটা এগিয়ে যায়। আমরা লক্ষ করেছি সেই ২০০৮ সালের একানব্বই-বিরানব্বই বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি কিন্তু আজকের ৪৮৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। তার একটি বড় কারণ দারিদ্র্য কমেছে এবং সাধারণ মানুষের কাছে অর্থনীতির সুযোগগুলো অনেকটাই পৌঁছেছে।

মধ্যস্বত্তভোগী একটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। বারবারই বলা হচ্ছে, এই মধ্যস্বত্তভোগীদের কারণেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা তাদের প্রাপ্যটা ঠিকঠাক পায় না। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় কি?

ড. আতিউর রহমান: মধ্যস্বত্তভোগী যেকোনো পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে থাকবে, এটা আমাদের দেশেও আছে। অর্থনীতির প্রয়োজনীয় অংশীজন তারা। কিন্তু অন্যান্য দেশে যেটা হয়, এই মধ্যস্বত্তভোগীদের একটা নিয়মের মধ্যে, একটা আইনের মধ্যে চলতে হয়। আমাদের এখানে অনেক সময় মধ্যস্বত্তভোগীরা আইন মানে না। অথবা সুশাসনের অভাবে তারা চাইলেও আইন মানতে পারে না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মধ্যস্বত্তভোগীদের পাশাপাশি যারা আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ থাকে তারাও ভাগ বসান। রাস্তায় যখন উত্তরবঙ্গ থেকে একটা ট্রাক আসতে থাকে জায়গায় জায়গায় ট্রাক থামে। তাদের সাথে বোঝাপড়া করতে হয়। যারা সমাজের সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তারাও আবার ঐ ট্রাক থামিয়ে থামিয়ে চাঁদা নেয়। এই চাঁদাবাজির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বাড়তি পরিবহন খরচ দাম বাড়ায়। এই মধ্যস্বত্তভোগীদের সংখ্যা কমিয়ে আনার একটা উপায় আছে, আর সেটা হলো যদি আমরা সত্যিকারের এইটা ই-কমার্স করতে পারি। গ্রামের একজন কৃষকের ফলানো বেগুনটা যদি স্থানীয়ভাবে কেউ সংগ্রহ করে ই-কমার্সের মাধ্যমে ঢাকায় ভোক্তাদের কাছে সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারে, তাহলে মধ্যস্বত্তভোগীর পরিমাণ কমবে। ঢাকার ভোক্তারা কম দামে ভালো পণ্য পাবে। আমার মনে হয় যে আগামী দিনের অর্থনীতি এ রকম ডিজিটাল অর্থনীতিই হবে। সেই সময় মধ্যস্বত্তভোগীদের সংখ্যা কমে যাবে। কিন্তু আপাতত মধ্যস্বত্তভোগীদের যে প্রাধান্য সেটা কমে যাবে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না। এই ঝক্কি নিয়ে আমাদের বাজার অর্থনীতিকে এগোতে হবে।

সামনে আমাদের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন সংক্রান্ত নানা ব্যস্ততা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে কী আরো বেশি চাপ আসতে পারে?

ড. আতিউর রহমান: অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে। বিশেষ করে পশ্চিমের অর্থনীতি খুবই চাপের মধ্যে আছে। যুক্তরাজ্যে এবং জার্মানিতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি, ১০ শতাংশেরও বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেশি। সেজন্য তারা নীতি সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। সুদের হার বাড়ানোর কারণে ডলারে বন্ড বিনিয়োগ আগের চেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে। আর তাই ডলারের দামও বাড়ছে। ডলারের দাম আমাদের টাকার মূল্যের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। মনে রাখা চাই বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ আমদানি মূল্য কিন্তু ডলারে পরিশোধ করা হয়। সেজন্য বর্তমানে যেকোনো পণ্য আমরা যখন আমদানি করছি সেটার দাম প্রায় ২৫ শতাংশ এমনিতেই বেড়ে যায়। এজন্য আমদানিজনিত একটা মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে আমরা লক্ষ্য করছি। বিশেষ করে শিশুখাদ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং অন্য যে খাদ্যপণ্যগুলো বাইরে থেকে আসছে, সেগুলোর দাম অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে আমাদের জন্য। এই জিনিসগুলো যখন আবার মধ্যস্বত্তভোগীদের মাধ্যমে বাজারে সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছে তখন আরেক দফা দাম বাড়ছে। সুতরাং দাম বেড়ে যাওয়ার এই যে প্রবণতা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না থামলে কমানো খুব মুশকিল হবে। খুব সহসাই যে এই ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যাবে সেটা আমি বলতে পারছি না। এ যুদ্ধ যে কবে থামবে তা বলা যাচ্ছে না। আর থামলেও পুরোনো বিশ্ব অর্থনীতি খুঁজে পাবো কি-না সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সেই কারণেই আমাদের সর্বদাই সাবধান থাকতে হবে। আর নির্বাচনের বছর সাধারণত যেটা হয়, গুজব ডালপালা মেলে এবং যারা রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তারা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কথা বলে, কৌশল আঁটে। এ কারণে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং অস্থির সমাজে অর্থনীতিও খুব বেশি সুস্থির থাকতে পারে না। সেখানেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। মানুষ মজুদ করে অনেক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। সেজন্য আমার মনে হয় এই বছরটিতে আমাদের জন্য সমাজে এবং রাজনীতিতে যেমন খানিকটা অস্থিরতার আশঙ্কা থাকবে, তেমনি অর্থনীতিতেও সুস্থিরতার অভাব হয়তো থেকেই যাবে। তাই খুব সাবধানে সবাইকে পা ফেলতে হবে।

বিদেশি ঋণ সহায়তায় আমাদের যে মেগা-প্রজেক্টগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় ২৫,২৬,২৭ সালে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সময় তো অর্থনীতিতে একটা বাড়তি চাপ পড়বেই, সেই বাড়তি চাপ সামাল দেয়ার কোনো রকম প্রস্তুতি কী আমাদের আছে?

ড. আতিউর রহমান: আসলে আমাদের মেগা-প্রজেক্ট যেগুলো হয়েছে সবগুলোই বিদেশি অর্থে হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। যেমন আমাদের পদ্মা সেতু আমরা নিজের পয়সায় করেছি। সেই সঙ্গে আরো অন্যান্য অনেক প্রকল্প আমরা নিজেদের অর্থে করেছি। বিশেষ করে সেতু ও রাস্তা তৈরিতে আমরা নিজেদের অর্থই বেশি বিনিয়োগ করেছি। তবে কিছু ক্ষেত্রে আমরা বিদেশি সাহায্য নিয়েছি। তার মধ্যে জাইকার সাহায্য নিয়ে আমাদের মেট্রোরেল হচ্ছে, আমাদের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। রেইল লাইন উন্নয়নে ভারত থেকে ঋণ নিয়েছি। এগুলো কিন্তু যথেষ্ট প্রডাক্টিভ সেক্টর এবং এরা পরিবহনকে সহজ করবে। ঋণ পরিশোধের যে ইনস্টলমেন্ট সেটা খুব শিগগিরই শুরু হবে না, গ্রেস পিরিয়ডও আছে। যে পরিমাণ ইনস্টলমেন্ট আমাদের পরিশোধ করতে হবে সেই সামর্থ্য কিন্তু আমাদের আছে। আমাদের যে পরিমাণ প্রবাসী আয় আছে, আমরা যে পরিমাণ রফতানি করি, সেখান থেকে আমরা নিশ্চয় এই ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারব। এখানে বড় কোনো অসুবিধা নেই। তবে ব্যক্তিগত কিছু বিদেশি ঋণের কিস্তির মূল্য ডলারের দাম বাড়ার কারণে বেড়ে গেছে। এটা নিয়ে অনেকেই অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কারণ অর্থনীতি তো বসে নেই, যখন এই মেগা-প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে তখন অর্থনীতির গতিও বাড়বে, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা আরো বাড়বে। সুতরাং সেখান থেকে খানিকটা অর্থ দিয়ে এসব জায়গায় আমরা কেন পরিশোধ করতে পারব না! এ প্রশ্ন আমার কাছে খুব অবান্তর মনে হয়। কারণ এতটা আশঙ্কা করার মতো পরিস্থিতি কিন্তু বিরাজ করছে না। সারা পৃথিবীতে আমাদের সঞ্চয়ের হার কিন্তু বেশি। আমাদের সঞ্চয়ের হার ৩৪ শতাংশ এবং সারা পৃথিবীতে যেটা ২৭ শতাংশ। আমরা নিজেরা প্রচুর সঞ্চয় করি। দ্বিতীয়ত হলো, আমাদের জিডিপির চেয়ে বিদেশি ঋণের যে পরিমাণ সেটা এখনো ২০ শতাংশের কম; যেটা পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কায় ৮০ বা ১০০ শতাংশের মতো। সুতরাং এতটা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। আর বিদেশি ঋণের বেশিরভাগই, প্রায় ৮০ শতাংশই কম সুদে দীর্ঘ সময়ের জন্য নেয়া। সুতরাং এটা নিয়ে এখনই এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।

পদ্মা সেতুর মতো আমাদের ডেভেলপমেন্টগুলোর ফলাফল যখন আমরা পেতে থাকব তখন আমাদের উৎপাদন বাড়বে, আমাদের যোগাযোগ সহজতর হবে। তাই আমাদের এতটা আশঙ্কা করার কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ জ্যোতিষীর মতো কথা বলেন, আমি তাদের মতো কথা বলতে পারি না। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ গতিময়। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বৈষম্য আছে। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বেশির ভাগ ঋণের অর্থ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এদের কারণে অর্থনীতি যে গতিতে এগোনোর কথা ছিল, সেটা হয়তো হয় না। কিন্তু তারপরও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ২০০৮-০৯ সালে বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক সংকট চলছিল, সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধি যখন মাত্র আধা শতাংশের মতো ছিল, তখনও আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৫ শতাংশ। কোভিডের মধ্যে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধি যখন এক থেকে দেড় শতাংশ, তখনও আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৪ শতাংশ। আর এই বছর আমরা ৬.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করব বলে আমরা আশা করছি। কিন্তু এই সংকট কালে সাড়ে ছয় থেকে সাত শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি মোটেও চাট্টি খানি কথা নয়। এই প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ থাকলেও ক্ষতি কী? আমি মনে করি, আমাদের এই সংকটকালে ছয়ের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন যথেষ্ট ভালো। বাংলাদেশের অর্থনীতি সেই অর্থে যথেষ্ট গতিময়। তার আত্মশক্তির জোর যথেষ্ট।

রিজার্ভ নিয়ে সরকার এক ধরনের কথা বলে আবার সরকারের সমালোচক যারা আছে তারা এক ধরনের কথা বলে। দুই ধরনের এই তথ্যের ব্যাপারটা একটু তর্কের বিষয়। কিন্তু আমাদের এমনিতেই কী পরিমাণ রিজার্ভ থাকাটা দরকার?

ড. আতিউর রহমান: রিজার্ভ বেশি থাকা ভালো। কারণ রিজার্ভ আমাদের শক্তি জোগায়, আমাদের আন্তর্জাতিক নেগোশিয়েটিং স্কিল বাড়ায়। তবে আমাদের এখনো যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে সেটি কিন্তু কম না। আমাদের গ্রস বা মোটের ওপর হিসেবে আছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফের নিট হিসাবে আছে ২৭ থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাব করার সময় এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে এক্সপোর্টারদের যে টাকাটা দেয়া হয় সেটা ধরে আমরা হিসাব করি। কারণ সে টাকাটা তো বসে নেই। সে টাকাটা তো নিয়মিত প্রতি মাসে বিনিয়োজিত হচ্ছে এবং রিটার্ন দিচ্ছে। আমরা ডলারে এই ঋণ দিচ্ছি আবার ডলারেই ফেরত পাচ্ছি। সুতরাং এটা আমাদের কাছে রিজার্ভের তারল্যের মতোই ভালো। এটা এমন না যে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে গেছে। এটা ঠিক কোনো কোনো বন্দর তৈরির কারণে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগের মতো নয়। সেটা মাইনাস করে নিট হিসাবেও বর্তমানে আমাদের যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে প্রতি মাসে আমদানি খরচ ৫ বিলিয়ন ডলার ধরলেও প্রায় ৬ মাস চলার মতো রিজার্ভ বাংলাদেশের আছে। আর এটা যদি পাঁচ মাসও ধরি ক্ষতি নেই তো। মিনিমাম যেখানে তিন মাসের আমদানি খরচের রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট। তবুও রিজার্ভ নিয়ে সাবধান থাকা উচিত। রিজার্ভ নিয়ে সবারই কথা বলা উচিত নয়। রিজার্ভ আমাদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা বিষয়। এগুলো নিয়ে আমার মনে হয় যত কম বিতর্ক হয় ততই ভালো। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই কথা বলুক।

‘নয় ছয়’ পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ঘোষণাটা দিয়েছিল সেটা তো আসলে সেই অর্থে এখনো মানা হচ্ছে না। এই পদ্ধতির ব্যাংকিং সিস্টেম অনুযায়ী দেখা যায় যে যারা বড় লোন নেয় বা যারা বিত্তশালী তারাই বেশি লাভবান হচ্ছে। সমাজের দরিদ্র শ্রেণির খুব একটা লাভ হচ্ছে না, বরং শোষিত হচ্ছে।

ড. আতিউর রহমান: আমার মনে হয় এই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট অনেক দেশেই হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারাও হিসবে করে দেখেছে যে বাজারনির্ভর থাকাটাই ভালো। রেট অব ইন্টারেস্ট এবং এক্সচেঞ্জ রেটের বেলায় বাজারনির্ভর থাকাটাই শ্রেয়। কেনিয়ার উদাহরণ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। তারা শেষ পর্যন্ত পূর্ব নির্ধারিত হার থেকে সরে এসেছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা রেট অব ইন্টারেস্ট যেমন কৃষকের জন্য বা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু ওভারঅল পুরো মার্কেটটাকে বাজারের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারলে সেটাই ভালো। আমাদের বেলায় এখন একটা এক্সপেরিমেন্ট চলছে। আমার ধারণা যে ধীরে ধীরে আমরা বাজার নির্ভরতার দিকেই চলে আসবো। এ রকম চাপিয়ে দেয়া কোনো সুদনীতি শেষ পর্যন্ত বাজার অর্থনীতির সঙ্গে একটু সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। এই টানাপোড়েন অর্থনীতির গতিমাত্রার জন্য মঙ্গলজনক নয়। তবে সামাজিক যে দায়বদ্ধতা সেটাও মাথায় রাখতে হবে। একটু সমন্বয় অবশ্যই করতে হবে। আমরা আশা করি, যারা রেগুলেট করছেন তারা এই বিষয়গুলো নিয়ে আরো ভাববেন, গবেষণা করবেন, অন্য দেশের অভিজ্ঞতা দেখবেন এবং দেখে শুনে সুচিন্তিত ব্যবস্থা নেবেন।

এবার একটু সাহিত্যের ব্যাপারে জানতে চাই। আমার একটু জানার কৌতূহল যে আপনি কী কখনো গল্প-কবিতা লিখেছেন?

ড. আতিউর রহমান: ছাত্রজীবনে একটা কবিতা লিখেছিলাম। সেই কবিতার কয়েকটি লাইন আমার ছবি দিয়ে সে সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বেরও হয়েছিল। সবাই মনে করেছিল আমি হয়তো কবি হয়ে গেছি। বয়সটাই ছিল কবি হবার। আবেগ-প্রবণ। শেষ পর্যন্ত আর কবি হওয়ার চেষ্টাই করি নি। এরপর আমি আর কবিতা লিখিনি। তবে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি, একসঙ্গে কাজ করেছি বলে কবিতা আমার খুব প্রিয় বিষয়। সমকালীন অনেক কবির সঙ্গে মেশার কারণে কবিদের একটা প্রভাব আমার ওপর সবসময় ছিল। আমি চেষ্টা করি, আমি যে গদ্যটা বলি কিংবা লিখি সেটার মধ্যেও যেন এক ধরনের গল্প থাকে, একটা কাব্যময়তা থাকে। সেটার মাধ্যমে অর্থনীতিকেও যে সাহিত্যের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় তার একটা চেষ্টা আমি করি। সে কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ আমার অর্থনীতিতে চলে আসেন, বঙ্গবন্ধুও চলে আসেন। সাহিত্যিক একটা মেজাজ থাকে আমার লেখার মধ্যে। সেই কারণেই বোধহয় বাংলা একাডেমি আমাকে রবীন্দ্র পুরস্কার বা সাহিত্য পুরস্কার দিয়েছে। আমিই হয়তো একমাত্র অর্থনীতিবিদ বাংলা একাডেমি যাকে সাহিত্য পুরস্কার দিয়েছে এবং সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আসলে আমি চেষ্টা করি সহজ করে সাধারণের ভাষায় কথাগুলোকে তুলে আনতে। তাদের দুঃখ কষ্ট ও সম্ভাবনার কথা সুযোগ পেলেই আমার লেখায় স্থান করে দেই। আমি মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল থেকে উপমা এই কারণে দিই যে কবিতার মাধ্যমে মানুষ তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা খুব অল্প কথায় বলে দিতে পারে। মোট কথা জীবনের নির্যাস হলো কবিতা। সুতরাং কবিদের কথা আমি অনেক গুরুত্ব দিয়ে বিচার করি এবং সেগুলো জানার চেষ্টা করি। কবিরা জীবন-কথক। তাদের সৃষ্টিশীলতা প্রবল। দর্শনও সুদৃঢ়।

এখন সমাজে একটা জিনিস দেখি যে ব্যাংকিং সেক্টর বা কর্পোরেট সেক্টরে যারা কাজ করেন তারা শিল্পমনা মানুষগুলোকে খুব একটা গুরুত্বের চোখে দেখেন না। তারা মনে করেন যে ওই মানুষগুলো কিছুটা অলস, কিছুটা ব্যর্থ। আবার শিল্পমনা মানুষগুলোও কর্পোরেট সেক্টরের লোকদের মনে করে এরা জীবনের মানে বোঝে না; শুধু খায়-দায় আর পাগলের মতো ব্যস্ত থাকে। এই দুটো সেক্টরের যদি সমন্বয় হতো তবেই তো একটা ভালো ও সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজ পেতাম। সেটা আপনার অভিজ্ঞতা থেকে জানতে চাই।

ড. আতিউর রহমান: আমি তো দুই জগতেই থেকেছি, আছি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যদি শুধুই লিখতাম, শুধুই পড়তাম তাহলে হয়তো এখন আরো স্বস্তিতে ও শান্তিতে থাকতে পারতাম। কিন্তু তাতে আবার সমাজের জন্য তেমন কিছু করার সুযোগ পেতাম না, সমাজকে কিছু দেয়া হতো না। তবে সমাজকে কিছু দেয়ার জন্য অনেক সময় গুরুত্বপুর্ণ অবস্থানে যেতে হয়। লক্ষ করলে দেখবেন, আমাদের দেশে অনেক বড় বড় অর্থনীতিবিদ আছেন তারা নিশ্চয়ই অনেক ভালো লেখেন, অনেক ভালো বলেন। কিন্তু সমাজটা বদলে দিতে পারেন না। আর সেজন্য একটা অবস্থান দরকার হয়। আমি দেখেছি, আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে না গেলে প্র্যাকটিক্যাল অর্থনীতিটা এত গভীরভাবে বুঝতাম না। একই সঙ্গে যারা সাধারণ মানুষ এই প্র্যাকটিক্যাল অর্থনীতি থেকে প্রান্তে চলে যাচ্ছে তাদের জন্য কিছু করার যে সুযোগ আমরা তৈরি করতে পেরেছি সেটাও পারতাম না। সেজন্য বলব, দুই জগতেরই গুরুত্ব আছে। তবে আমাদের অর্থনীতির একটি মানবিক অবদান থাকা উচিত, যেটাকে আমি সামাজিক দায়িত্ববোধ বলি। আমাদের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের আসলে সমাজের লালন করা উচিত, তাদেরকে একটা সুযোগ করে দেয়া উচিত।

আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে অনেক সময় সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে কবি-সাহিত্যিকদের জন্য কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম। অনেক কবির আত্মীয়দের আমি বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। দায়িত্ববোধ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে অনেক বিপ্লবীকে আমরা চলার মতো ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অনেক লেখককে আমরা কিউবা পর্যন্ত পাঠিয়েছি চোখের অপারেশনের জন্য। অনেক ব্যাংককে সৃজনশীল সাহিত্য পুরস্কার সূচনা করতে উৎসাহ দিয়েছি। অনেক ব্যাংককে ভালো বই কিনতেও উৎসাহিত করেছি। সুতরাং এই যে সামাজিক দায়বোধ আমাদের অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর; ব্যাংক খাত বা অন্য কর্পোরেটগুলোর থাকা উচিত এবং সেই জায়গাগুলোকে আমাদের উৎসাহিত করা উচিত বলে আমরা মনে করি। কারণ আমরা তো এই সমাজের কাছ থেকে অর্থ নিয়েই কর্পোরেটগুলো পরিচালনা করি। সুতরাং তাদেরও একটা সামাজিক দায়বোধ থাকা উচিত এই সমাজের জন্য কিছু করার। ভারতে কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স বলে একটা আলাদা মিনিস্ট্রি আছে। সেই কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্রি সব কর্পোরেটের কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স আদায় করে এবং সেই ট্যাক্স দিয়ে সমাজের এই অসংগতি যেখানে আছে সেটা দূর করার চেষ্টা করে। সংগঠনগুলোকে হেল্প করে কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পের কাজ যারা করে তাদের পাশে দাঁড়ায়। সুতরাং এটা আমরা ব্যাংক থেকে একটা অনানুষ্ঠানিকভাবে চেষ্টা করেছিলাম খানিকটা, কিন্তু আমার মনে হয় যে রাষ্ট্রেরও এ রকম একটি আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া উচিত, সমাজে যারা হৃদয়বৃত্তি করছে তাদের জন্য আমাদের কিছুটা সুযোগ করে দেয়া উচিত। আমাদের কিছু ব্যাংক কিন্তু আজকাল সাহিত্য পুরস্কার দেয় এবং তার ভালো মূল্যমানও আছে। এসব কাজে প্রতিটি ব্যাংক বা প্রতিটি কর্পোরেটকে আরো বেশি উৎসাহ দেয়া উচিত যে আমাদের যারা সৃজনশীল কাজ করছেন, যারা আমাদের শিল্পী, যারা আমাদের মনের দরজা খুলে দিচ্ছেন এবং আমাদের মনোজগৎকে বিস্তৃত করছেন, তাদের পাশে যেন রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেটগুলোও দাঁড়ায়। এই উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছু কাজ করেছিলাম। আশা করি, এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

আপনি লেখক হওয়ার কারণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আগের চেয়ে আমাদের পাঠক কমে গেছে। একাডেমিক শিক্ষিত মানুষ তো অনেক, আমাদের শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। তার বিপরীতে আমাদের ফিকশন, নন-ফিকশন যেকোনো ধরনের বইয়ের পাঠক অ্যাভারেজে কমছে। আমি মনে করি যে এর দুটো কারণ থাকতে পারে। এক. আমি যে পড়ব সেজন্য ছোটবেলা থেকে পাঠক হয়ে ওঠার একটা প্রস্তুতি বা প্রক্রিয়া থাকে, এক্ষেত্রে হয়তো তার ফ্যামিলিতে একটা ছোট লাইব্রেরি থাকে অথবা সে ছোটবেলা থেকেই বই পড়া কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত; সেই বিষয়গুলোর অভাব। দুই. এখনকার লেখায় এই প্রজন্মের পাঠকের প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব বলে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে?

ড. আতিউর রহমান: আসলে সমাজটা তো বদলে যাচ্ছে, প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। আজকের নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি নিয়ে পড়ে আছে, তারা কাগজে পড়ার চেয়ে মোবাইলে-কম্পিউটারে বেশি পড়ছে; কিংবা অডিওর চেয়ে ভিজ্যুয়ালকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সুতরাং আমাদের মনে হয় আমরা যারা লেখক আমাদেরও তরুণদের আকর্ষণ করার জন্য খানিকটা প্রযুক্তির চর্চা করা উচিত। তারা যে ধরনের মাধ্যমকে বেশি গুরুত্ব দেয়, আমাদেরও সে রকম মাধ্যমে মাঝে মধ্যে এসে তাদের মনের জগতে নাড়া দেয়া উচিত। আমরা লক্ষ্য করেছি, আমরা যখন সাহিত্যের কথা, সংস্কৃতির কথা ছোট ছোট শর্ট ভিডিওতে তরুণদের কাছে পৌঁছাই তারা কিন্তু তা গ্রহণ ও রিঅ্যাক্ট করে। সুতরাং একদিকে আমরা বই লিখব অবশ্যই, কিন্তু সেই বইতে কী আছে সেটা ছোট্ট করে হলেও তরুণ মনের কাছে বিভিন্ন ফরমেটে প্রকাশ করব, তাতে করে ওই বইগুলোর আকর্ষণ তাদের কাছে বাড়বে এবং তখন তারা বইগুলো কিনবে। বইটাও যেন খুব সহজে অনলাইনে পাওয়া যায়, ই-বুক আকারে পাওয়া যায় সেদিকেও আমাদের লেখকদের যত্নবান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

সাহিত্য তো জীবনের একটা অংশ। ছোট হোক বড় হোক, কিন্তু যে অর্থনীতি দিয়ে আমরা বেঁচে থাকি সে অর্থনীতিতেও তো সাহিত্য থাকে। বাঁচার সৌন্দর্যের মধ্যেও তো সাহিত্য থাকে এবং সেটাই প্রকৃত সাহিত্য। আপনি সেই জিনিসটা করেছেন, রবীন্দ্রনাথের অর্থনীতি নিয়ে তার অন্য সবকিছু নিয়ে। আপনার লেখা পড়ে এবং আরো বিভিন্ন রবীন্দ্র গবেষণা পড়ে আমার মনে হয়েছে, আমরা ধরে নিই রবীন্দ্রনাথ এখনো প্রাসঙ্গিক। তবে এই ব্যাপারটা আমার কাছে ইতিবাচক মনে হয় না। কারণ রবীন্দ্রনাথ ১০০ বছর বা তারও আগে যে সমস্যার কথা বলে গেছেন আমরা সেই সমস্যাটা এখনো উৎরে যেতে পারি নাই। সেজন্য আমাদের রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটা এখনো শুনতে হচ্ছে, সেই কথাটা বারবার পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। আপনারা বারবার কথাগুলো বলছেন, এই জায়গায় রবীন্দ্রনাথ এই কথাটা বলেছেন কিন্তু আমাদের সমাজ এখানে আছে এখনো। তার মানে আমরা কি পিছিয়ে যাচ্ছি? আমরা কি স্থবির হয়ে আছি?

ড. আতিউর রহমান: না। আমার তো মনে হয় রবীন্দ্রনাথ যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো চিরন্তন। মানে যুগে যুগে শতাব্দীর পর শতাব্দী সেই কথাগুলো প্রাসঙ্গিক থাকবে। কারণ সেগুলো মানুষের মনের কথা। মনের পরিবর্তনের কথা। সেদিক থেকে মনে করলে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আধুনিক একজন মানুষ এবং সেই অর্থে তিনি নিরন্তর প্রাসঙ্গিক। কারণ তিনি প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, তিনি দুটি শতাব্দীতে বাস করেছেন। তিনি পশ্চিম ও পূবের সভ্যতাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি দেখেছেন জমিদাররা কীভাবে প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে, সেজন্য তিনি জমিদারদেরও সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন, প্রজাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। নিজে কাজ করে দেখিয়েছেন যে কী করলে কৃষকের আত্মমুক্তি আসে। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে শুধু বিদ্যালয় না তিনি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের বিদ্যালয়ে পরিণত করার জন্য চীন, জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ড থেকে তিনি অধ্যাপকদের নিয়ে এসেছেন, তাদেরকে যুক্ত করেছেন। বিশ্বের জ্ঞান তিনি শান্তিনিকেতনে বপন করেছেন। বিশ্বভারতীর চিন্তা বিশ্ব সভ্যতায় যুক্ত করেছেন।

সুতরাং এই বিষয়টি আজকের দিনেও খুব প্রাসঙ্গিক। আমরা শুধু কূপমন্ডু তা নিয়ে একটা ঘরের মধ্যে শিক্ষাকে আবদ্ধ করতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কোনো একটা শিক্ষালয়ের মধ্যেই শিক্ষা আবদ্ধ থাকতে পারে না, জীবন এক বিরাট পাঠক্রম। সুতরাং শিক্ষালয়ের বাইরের যে জীবন সেটিও আমাদের পাঠের তালিকাভুক্ত। এই কথাটিতো আর যুগে যুগে বদলাবে না। এটি এই শতাব্দীতে যেমন সত্যি আগামী শতাব্দীতেও একই রকম সত্যি। তবে আগামী শতাব্দীতে হয়তো জীবনের যে পাঠক্রম সেটা বদলে যাবে কিন্তু জীবন তো থাকবেই। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ এবং জীবন একেবারে অঙ্গাঙ্গীভাবে আমাদের জন্য থেকেই যাবেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ না, রবীন্দ্রনাথ প্রতীকী অর্থে বলছি, রবীন্দ্রনাথের মতো যারা সৃজনশীল, যারা উদ্ভাবনী চিন্তা করেন, তারা চিরদিন আমাদের মনের খাবার জোগাড় করে যাবেন, আমাদের মনকে সতেজ রাখবেন। সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ এতটা প্রাসঙ্গিক।

ধর্মান্ধতা শ্রেণি-বৈষম্যের মতো নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার কথা রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। আমি বিশেষ করে সেই সমস্যাগুলো ধরে বলছি, সেই সমস্যাগুলো তো এখনো আমাদের আছে। তবে কী আমরা এগোচ্ছি না স্থবির হয়ে আছি?

ড. আতিউর রহমান: এগুলো চিরন্তর সমস্যা। এগুলো মোকাবেলা করার জন্য যুগে যুগে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং নেতারা এসেছেন। আমরা দেখেছি সুভাষ বসু এগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, আমাদের বঙ্গবন্ধু এগুলোর বিরুদ্ধে শুধু সংগ্রামই করেছেন তাই না, তিনি সংবিধানেও লিখেছেন, ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের অধিকার থাকবে কিন্তু ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা যাবে না। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। আমার মনে হয় যে এসব চিন্তা বা চেতনা যুগে যুগে আমাদের সাহিত্যিকরা জুগিয়েছেন এবং তারাও মানবিক হওয়ার জন্য আহ্বান করেছেন বলেই আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এবং দেশনায়করা তাদের এই ভাবনাগুলোকে আমাদের রাজনীতিতে-সমাজে নিয়ে এসেছেন। সুতরাং আমি মনে করি, সাহিত্যিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসংস্কারক সবারই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ এগিয়ে যায়। সেখানে অবশ্যই সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ তাদের সবার ভাবনাই যুক্ত থাকে সাহিত্যের মাধ্যমে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসকেই যদি পড়ি, সেখানে শুধু ওই সময়টাকেই ধরেনি, বরং সারা পৃথিবীর যে পরিবার সেটাকেও ধরার চেষ্টা করেছেন। আমার মনে হয় আমাদের রাজনীতিকে, আমাদের সমাজকে যদি মানবিক করতে চাই তাহলে সাহিত্য চর্চার কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে বিজ্ঞান চর্চার সাথেও সাহিত্য চর্চার নিবিড় সম্পর্কের কথা রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। সাহিত্যিকদের যেমন বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে, তেমনি বিজ্ঞানীদেরও সাহিত্য-বান্ধব হতে হবে বলে রবীন্দ্রনাথ আশা করেছেন। এভাবেই সাহিত্য ও বিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে।

আরও পড়তে পারেন

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে নতুন করে আরও প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা…
জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

ঈদুল আজহার আগেই বাজারে ছাড়া হচ্ছে নতুন ডিজাইনের টাকার নোট, যা দুই টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত…
পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

সৌদি আরব হজ পারমিট সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যারা বৈধ…