এশিয়ায় ন্যাটোর সম্প্রসারণের ইঙ্গিত!

পশ্চিমের সব নেতারা এখন রাশিয়ার প্রতিবেশী লিথুয়ানিয়ায় জড় হয়েছেন। বাল্টিক সাগরের পাশে ছোট্ট এই সাবেক সোভিয়েত দেশের রাজধানী ভিলনিয়াসে আগামী দু’দিন ধরে ন্যাটো সামরিক জোটের শীর্ষ বৈঠক হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনকে দ্রুত ওই জোটের সদস্য করা বা না করা বিষয়টিই বৈঠকের মুখ্য বিষয় হবে। একই সাথে জোটের কোনো দেশ রুশ হামলার শিকার হলে, কিভাবে তা মোকাবেলা করা হবে তার নতুন প্রস্তাবিত একটি কৌশল নিয়ে কথা হবে বলে জানা গেছে।

এছাড়াও বৈঠকের অ্যাজেন্ডায় রয়েছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের চারটি দেশের সাথে ওই জোটের সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক এক কাঠামো তৈরি। ভিলনিয়াসে তাই হাজির থাকবেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়ল, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এ্যান্থনি আলবানিজ ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিস হিপকিন্স। জোটের সদস্য না হয়েও এই চার এশীয় দেশ পরপর দ্বিতীয়বারের মতো ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিচ্ছে।

গত বছর মাদ্রিদের শীর্ষ বৈঠকে প্রথমবারের মতো তাদের অংশগ্রহণের পর থেকেই সন্দেহের দানা বাঁধতে থাকে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরি এই পশ্চিমা সামরিক জোট কি এখন এশিয়ায় তাদের সম্প্রসারণ চাইছে? জানুয়ারিতে জাপানে গিয়ে ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ টোকিওতে ন্যাটো জোটের একটি লিয়াজো অফিস খোলার বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন- এমন খবর ফাঁস হওয়ার পর ওই সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়।

আর এখন পরপর দ্বিতীয়বারের জোটের শীর্ষ বৈঠকে এশিয়ায় যুক্তারাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ওই মিত্রদের অংশগ্রহণ ওই সন্দেহকে শতগুণে বাড়িয়ে দিবে। এশীয় ও প্রশান্ত মাহসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ন্যাটোর সহযোগিতার একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকে গৃহীত হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সহযোগিতার পরিধি কতদূর

জানা গেছে, ওই চার দেশ আলাদাভাবে তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ন্যাটোর সাথে সহযোগিতা চুক্তি করতে চলেছে। যে চুক্তির নাম দেয়া হয়েছে ইনডিভিজুয়ালি টেইলরড পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (আইটিপিপি)। নিকেইসহ জাপানের একাধিক নির্ভরযোগ্য মিডিয়া গত সপ্তাহে খবর দিয়েছে, টোকিও এবং ক্যানবেরা ন্যাটোর সাথে আইটিপিপি চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে নিকেই বলেছে, জাপান ও ন্যাটোর মধ্যে সহযোগিতার ১৬টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড ন্যাটোর সাথে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা মীমাংসা চালিয়েছে। তবে তাদের চুক্তিগুলো ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকের আগে চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়েছে কি-না তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

আইটিপিপি চুক্তিগুলোকে ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকে সদস্যদের সামনে রাখার পর সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হতে পারে। জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ওই চার দেশের সাথে ন্যাটো জোটের সহযোগিতার প্রধান যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো : সমুদ্রে জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশে নিরাপত্তা ও যেসব ডিজিটাল প্রযুক্তি সাইবার জগতে হুমকি তৈরি করতে পারে, যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মীমাংসা হয়েছে যে ন্যাটো বাহিনী এবং ওই চার দেশের সামরিক বাহিনী নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও যোগাযোগ বাড়াবে। যেন প্রয়োজনে তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে যৌথভাবে কাজ করতে পারে।

কেন এখন এশিয়ার দিকে নজর ন্যাটোর

লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কর্মসূচির গবেষক বিল হেইটন সম্প্রতি সংস্থার সাইটে এক নিবন্ধে লিখেছেন, এশিয়াতে ন্যাটো জোটের নজর নতুন নয়। ওই চার দেশ ও ন্যাটোর মধ্যে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে বিচ্ছিন্নভাবে সহযোগিতা চলছে।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল কায়দার হামলার পর আফগানিস্তানে ন্যাটোর নেতৃত্বে ইসাফ বাহিনীতে সৈন্য পাঠিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া। জাপানের সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের নৌবাহিনী ইসাফকে বিভিন্ন ধরনের লজিস্টিক সাহায্য করেছিল। অনেক পর্যবেক্ষকও মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে আতঙ্কিত দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ন্যাটোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আগ্রহী। তবে বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর নজরের প্রধান কারণ এখন চীন।

সুইডেনের গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পলিসির একটি প্রকাশনায় এক বিশ্লেষণে গবেষক হাসিম টুরকের লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মনোযোগ এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে, ফলে ন্যাটোর অগ্রাধিকারে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। তার মতে, প্রায় পাঁচ বছর ধরেই চীনের ব্যাপারে ন্যাটো জোটের মনোযোগ বাড়ছে।

ক্রোধে ফুঁসছে চীন

বৈরি প্রতিবেশী জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ন্যাটো সামরিক জোটের এই দহরম মহরমে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত চীন। তারা মনে করছে, তাদের কোণঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে এশিয়ায় সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মাদ্রিদে গত বছর ন্যাটো শীর্ষ বৈঠকের পরপরই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ব্রিকস জোটের এক ভার্চুয়াল শীর্ষ বৈঠকে দেয়া ভাষণে বলেন, ‘কিছু দেশ নিরাপত্তার অজুহাত তুলে এশিয়ায় সামরিক জোটের বিস্তার করতে চাইছে।’ তিনি সাবধান করেন, ‘এই প্রবণতা চলতে দেয়া হলে বিশ্বে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে।’

ন্যাটোতে মতভেদ

এশিয়ায় বেশি নজর দেয়ার প্রশ্নে ন্যাটো জোটের মধ্যেও মতভেদের ইঙ্গিত রয়েছে। বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণা-ভিত্তিক সাময়িকী পলিটিকো তাদের ৩ জুলাইয়ের সংস্করণে এক প্রতিবেদনে লিখেছে, টোকিওতে ন্যাটো জোটের লিয়াজো অফিস খোলার প্রস্তাবে বাধা দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তিনি নাকি বলেছেন, এশিয়ার দিকে ন্যাটো নজর বাড়ালে মূল লক্ষ্য অর্থাৎ ইউরোপের নিরাপত্তা অবহেলিত হবে।

শুক্রবার প্যারিসে এলিজি প্রাসাদে এক সংবাদ সম্মেলনে জাপানে ন্যাটো জোটের অফিস খোলার ব্যাপারে এক প্রশ্নে ফরাসি প্রেসিডেন্টের এক মুখপাত্র বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা এর বিরোধী।’ ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ন্যাটো জোটের বেশ কিছু ইউরোপিয় দেশ চীনের সাথে সম্পর্ক আরো চটাতে উৎসাহী নয়। চীনকে কতটা চটানো উচিৎ তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিতর্ক রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল কিটিং ন্যাটোর সাথে তার দেশের আনুষ্ঠানিক কোনো সহযোগিতা চুক্তির বিরোধী। এ ধরনের চুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার জন্য কিটিং সম্প্রতি ন্যাটো মহাসচিব স্টলটেনবার্গ সম্পর্কে বলেছেন, ‘লোকটি একটি সুপ্রিম ফুল (মহা আহাম্মক)।’

সূত্র : বিবিসি