
কী হতে পারে বিশ্বায়নের স্বরূপ !
- আন্তর্জাতিক
- নভেম্বর ১৭, ২০২২
সময় কত বদলে গেছে। পুরোনো দিন ও বর্তমানের মধ্যে কত ফারাক। আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের আগে জীবন কত মন্থর ছিল। মানুষ ইচ্ছা করলেই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে পারত না, পণ্য বিনিময় করতে পারত না এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ও হতো না। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে বিশেষভাবে এশিয়া ও আফ্রিকায় ইউরোপীয় দেশগুলোর উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিশ্বায়নের প্রথম যাত্রা আজকের বিশ্বায়নের রূপ নিয়েছে দেশে দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার আকারে। বিশ্বায়নকে যদি সাবেক উপনিবেশবাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে এর ক্ষেত্রকে সমাজ গবেষকরা আরো ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা পরিবার, ধর্ম, পেশা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি পর্যন্ত ব্যাপ্ত। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া তাই জটিল। এ জটিলতা ক্রমেই বাড়তে থাকবে একদিকে পরাশক্তিগুলোর দাপটে, অন্যদিকে পরাশক্তিগুলোর ওপর পিছিয়ে থাকা দেশ ও জাতিগুলোর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলো যেকোনো শর্তে উন্নত দেশের বাহুলগ্ন হয়ে থাকতে চায়। ফলে পরাশক্তিগুলো এখন আর কোনো দেশকে দখল করে উপনিবেশ সৃষ্টি করে না, নির্ভরশীল দেশগুলোই পরাশক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের পাহারা দেয়। বর্তমান বিশ্বায়ন কোনো দেশের পুরো সমাজ ও জনগোষ্ঠীর সর্বনাশের কারণ ঘটায় সীমিতসংখ্যক লোকের সুবিধার বিনিময়ে।
আমরা যদি শুধু গত দশকের চিত্রের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশ ও তাদের দরিদ্র জনগণই বিশ্ব অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। এসব দেশের অর্থনীতি নজিরবিহীন হারে সম্প্রসারিত হয়েছে, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির তাৎপর্যপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। বর্তমান দশকে, অতি সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নশীল দেশ ও উন্নত দেশের মধ্যে প্রবৃদ্ধি হারের পার্থক্য ৫ শতাংশ পয়েন্টের অধিক এবং সমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনৈতিক সাফল্যে কিছুটা ভাটা পড়েছে তাদের অর্থনীতির ওপর কোভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিকাশকে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টের ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল ইকোনমির প্রফেসর ড্যানি রডরিক কৃত্রিম বিকাশ বলে মনে করেন, যা তাঁর মতে, ‘বিশ্বায়নের নেতিবাচক একটি দিক। কারণ উন্নত দেশগুলো কখনো অনুন্নত দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন অথবা সুশাসনের কথা ভাবে না। এসবকে তারা মনে করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর একান্তই নিজস্ব উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপার।’ পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ক্ষেত্রে উন্নত দেশ ও বহুজাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর পিছটান দেওয়া থেকে তা কিছুটা উপলব্ধি করা যেতে পারে। তারা উন্নয়নশীল দেশের সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করিয়ে নিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে তথাকথিত বিশ্বায়নের আওতায়।
চল্লিশের দশকে তুরস্ক এবং আশির দশকে মালয়েশিয়া নিজেদের উদ্যোগে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দিয়েছিল, যার সুফল তারা লাভ করেছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে
অবকাঠামো উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে অনেক এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। চল্লিশের দশকে তুরস্ক এবং আশির দশকে মালয়েশিয়া নিজেদের উদ্যোগে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দিয়েছিল, যার সুফল তারা লাভ করেছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সব অনুন্নত দেশের নেতাদের মেরুদন্ড ততটা শক্ত নয়। প্রফেসর রডরিক বলেছেন, ‘অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সুশাসন নিশ্চিত হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কর্মীরা তাদের কর্ম-সামর্থ্যরে শতভাগ কাজে লাগাতে পারবে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি হলে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর ওপর উন্নত দেশগুলো বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে একচেটিয়া খবরদারি করতে পারবে না।
সন্দেহ নেই যে, এখনকার দৃশ্যত উদার বিশ্বায়ন বিশ্ব পুঁজিবাদের নতুন এক রূপ, যেখানে উন্নত বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলো বিশ্বের সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থায় সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে, তারাই পৃথিবীর মোট কর্মশক্তির প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনকে নিয়োগ করার এখতিয়ার প্রয়োগ করছে। খুব ছোটখাটো পণ্য থেকে শুরু করে অতি উচ্চপ্রযুক্তির উপকরণ, মৌলিক ভোগ্যপণ্য থেকে ভারী কারখানার সরঞ্জাম, খাদ্য থেকে শুরু করে সেবা খাত, বিশ্ববাজারের জন্য পণ্য সবই প্রস্তুত হচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বহুসংখ্যক দরিদ্র, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এবং এসবের সমন্বয় করছে উন্নত দেশগুলোর হাতে গোনা কয়েকটি বড় কোম্পানি এবং তা তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। এর ফলে যা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র যে ১৫ শতাংশ বড় কোম্পানি, তারাই বিশ্বের পুরো ব্যবসার ৮০ শতাংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই নজিরবিহীন বিশ্বায়ন ও একচেটিয়া ব্যবসা বিনিয়োগযোগ্য পুঁজিকে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে দিচ্ছে না। ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ মাইকেল রবার্টস বলেছেন, বিশ্ব পুঁজির ওপর নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ঘাটতি পড়লে তারা এজন্য প্রকারান্তরে দোষ চাপায় শ্রমজীবী মানুষের ওপর এবং তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নমূলক আচরণ শুরু করে। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলো শ্রমজীবী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার পরিবর্তে উন্নত দেশের কোম্পানিগুলোর মর্জি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
অল্পবয়সী চীনা মেয়েরা অধিকাংশই শিল্প-কারখানাগুলোর ডরমিটরিতে বাস করে, সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব নিয়ে কথা বলার জন্য চীনে কোনো শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। চীন ছাড়াও বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকোসহ আরো অনেক দেশে শ্রমিকরা বিশ্বায়নের চাপে নিপিষ্ট
চীনের শ্রমশক্তি বিশ্বের বৃহত্তম, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত স্থাপনাগুলোয় কাজ করে। তাদের যদি কোনো বেতন বা মজুরি দেওয়া হয়, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো স্থানের তুলনায় সে বেতন বা মজুরি হার অতি নিম্ন এবং চীন সরকার শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার প্রতি মনোযোগ দেয় না। কিন্তু সেই একই চীনা সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোকে প্রায় ‘জিরো’ ট্যাক্স রেটের সুবিধা প্রদান ছাড়াও অন্যান্য ছাড় দিয়ে থাকে। অল্পবয়সী চীনা মেয়েরা অধিকাংশই শিল্প-কারখানাগুলোর ডরমিটরিতে বাস করে, সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টার অধিক সময় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব নিয়ে কথা বলার জন্য চীনে কোনো শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। চীন ছাড়াও বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকোসহ আরো অনেক দেশে শ্রমিকরা বিশ্বায়নের চাপে নিপিষ্ট। এমনকি ‘অ্যাপল’-এর মতো বড় কোম্পানি চীনে প্রায় ১০ লাখ কর্মী নিয়োগ করেছে ক্রীতদাসতুল্য মজুরি ও অধিক কর্মঘণ্টায়। অ্যাপল তাদের আইফোন বিক্রি করছে এক হাজার ডলার মূল্যে, যার মধ্যে মাত্র গুটিকয়েক ডলার যায় চীনা ও অন্যান্য এশিয়ান শ্রমিকদের কাছে।
বিশ্বায়নের এ অবস্থা শুধু শ্রমিক শোষণ ও বিনিয়োগকারীদের মুনাফা আহরণের ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে যে সামাজিক অবক্ষয় ও বিপর্যয় ঘটছে তাও নজিরবিহীন। পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলো তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায়, যা তাদের নিজ দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি করেছে এবং যারা কাজে নিয়োজিত রয়েছে সর্বত্র তাদের বেতন নিম্নমুখী হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতি হার ৯ শতাংশ, যা চল্লিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্য ও সেবারও মূল্যবৃদ্ধি বহু দশকের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতেও কম-বেশি একই অবস্থা বিরাজ করছে। এর নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া উন্নত বিশ্বের সর্বত্র দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে ইমিগ্রেশনবিরোধী বর্ণবাদী মনোভাবের মধ্য দিয়ে। কারণ উন্নত দেশগুলোর বেকার হয়ে পড়া নাগরিকদের বড় অংশই মনে করে যে ইমিগ্র্যান্ট শ্রমিকরা যেহেতু বিদেশের মাটিতে তাদের বেঁচে থাকার স্বার্থে যেকোনো মজুরিতে শ্রম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে, সেজন্য দেশগুলোর নাগরিকরা কর্মচ্যুত হচ্ছে অথবা তাদের মজুরি হ্রাস করা হচ্ছে।
ইমিগ্র্যান্ট সমস্যা অনেক উন্নত দেশে অন্যতম রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। গত বছরের ঠিক এ সময়ে (জুলাই ২০২১) বিশ্বব্যাংকের বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের একটি অংশ ‘দ্য এক্সিকিউটিভ কমিটি অন্য ডেভেলপমেন্ট অ্যাফেক্টিভনেস’ বিশ্বায়নের সামাজিক ও পরিবেশগত নিরাপত্তার ওপর একটি খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করে। এ নীতিমালার অন্যতম দিক ছিল ব্যাপক অর্থে মানবাধিকার-কেন্দ্রিক, বৈষম্য থেকে মুক্তি এবং এক কথায় প্রগতিশীল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এ খসড়া নীতির ওপর বিশ্বব্যাংকের বোর্ড অব ডাইরেক্টরসে কোনো আলোচনা হয়নি। অতএব, অনুমোদন লাভেরও প্রশ্ন আসে না। কেন আলোচনা হয়নি, তা স্পষ্ট। বিশ্বব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে না।