
কৃষি জমির সুরক্ষা
- নিবন্ধ
- ডিসেম্বর ১০, ২০২৩
কৃষি কর্ম প্রকৃতি-নির্ভর। সময় এবং পরিবেশ অনুযায়ী উদ্ভিদ এবং প্রাণী সম্পদকে কাজে লাগিয়ে কৃষক তার ফসল ঘরে তোলে। শ্রমঘন এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের জন্য যে উপাদান অপরিহার্য্য তা হচ্ছে আবাদী জমি।
জনসংখ্যায় বিশাল কিন্তু আয়তনে ক্ষুদ্র একটি দেশ আমাদের বাংলাদেশ। জনসংখ্যার এই চাপ আছে সামগ্রিক উৎপাদনে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। চাপে আছে দেশের ভূসম্পদও। আর চাপে থাকবেই না কেন? ভুমির যোগান তো সীমিত। অথচ চাহিদা ব্যাপক। দিনকে দিন জমির চাহিদা বাড়ছে। দেশের ৩ কোটি ৬০ লক্ষ খানা আবাসনের জন্য চাই জমি, খাদ্য উৎপাদনের জন্য চাই জমি, শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য চাই জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক স্থাপনা, পার্ক, রাস্তা ঘাট অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চাই জমি। মৃতের সৎকার এবং কবরস্থ করার জন্যও চাই জমি। এইসব সনাতনী চাহিদার পাশাপাশি আবার তৈরি হচ্ছে নতুন চাহিদাও। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের জন্য বাগানবাড়ি, রিসোর্ট, কন্ডোমিনিয়াম এর মতো আবাসিক প্রকল্প তৈরিতে প্রয়োজন হচ্ছে জমির। বোঝাই যাচ্ছে জমির প্রয়োজন কত গুরুত্বপূর্ণ আর ব্যবহার কত বহুমাত্রিক।
দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা কৃষির সাথে সম্পৃক্ত, তবে দেশের মোট জনসংখ্যার জন্য যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশের যোগান আসে দেশের কৃষিখাত থেকে। তাই কৃষি কাজে ব্যবহৃত জমির সঠিক পরিকল্পনা, সুষম বন্ঠন ও সংরক্ষণ অতীব জরুরি।
আবাদী জমির অবস্থান শহরের বাইরে, গ্রামে। এই সব আবাদী জমির মালিক অধিকাংশই দরিদ্র কৃষক যাদের অধিকাংশই স্থানীয় ক্ষমতাধর প্রভাবশালীদের থাবার নিচে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সুতরাং তাদের চলমান জীবিকার অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ থাকে। গণতন্ত্রায়নের ধারা বজায় রাখতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্বলিত একটা ছাতা তাদের ওপর মেলে দেওয়া আছে সত্যি তবে সে ছাতা ধরার সুযোগ থাকে প্রভাবশালীদের হাতেই
কৃষকের আমানত হচ্ছে আবাদী জমি। এটা কৃষকের মূলধনও বটে। কৃষকের হাতে গচ্ছিত এই জমি কি ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কি ভাবে সংরক্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষণা এবং মিডিয়ার তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো গত তিন দশক ধরে আমাদের আবাদী জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ জমির সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর পাশাপাশি আবাদী জমির পরিমাণ কমছে। অর্থাৎ কৃষকের গচ্ছিত আমানত খোয়া যাচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় কৃষি খাতে ব্যবহৃত জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে অথবা ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে। কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণটা বিবিধ।
আবাদী জমির অবস্থান শহরের বাইরে, গ্রামে। এই সব আবাদী জমির মালিক অধিকাংশই দরিদ্র কৃষক যাদের অধিকাংশই স্থানীয় ক্ষমতাধর প্রভাবশালীদের থাবার নিচে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সুতরাং তাদের চলমান জীবিকার অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ থাকে। গণতন্ত্রায়নের ধারা বজায় রাখতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্বলিত একটা ছাতা তাদের ওপর মেলে দেওয়া আছে সত্যি তবে সে ছাতা ধরার সুযোগ থাকে প্রভাবশালীদের হাতেই। তাদের অবস্থান গ্রামীণ ক্ষমতা বলয়ের কেন্দ্রে। দিনকে দিন আবাদী জমি যে অকৃষি খাতে রূপান্তরিত হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ার নেপথ্য কারিগররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু এই ক্ষমতা বলয়ের লোকজন।
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের জন্য নদী ভাঙন এবং পাহাড়ি ঢল কৃষি জমির জন্য বড় হুমকি। ২০১৭ সালে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল ও ফসলী জমি রক্ষা বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ফসলহানি হয়। সমালোচনার মুখে ঠিকাদারি প্রথা বিলুপ্ত করে অংশীজন, প্রশাসন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যুক্ত করে প্রকল্প নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যার মূল অংশীজন প্রকৃত কৃষক। কয়েক বছর যেতে না যেতেই প্রকৃত সুবিধাভোগী কৃষকদের সামনে রেখে এই কমিটি মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটে রূপ নেয়। এদের অনিয়ম, গাফলতি ও স্বার্থের কারনে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ দীর্ঘায়িত হচ্ছে পাশাপাশি কৃষকের ফসল উৎপাদন ব্যাপক ঝুঁকির মুখে পড়ছে। দিনাজপুরের হিলি উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের সেচ পাম্পটি পরিচালনা করেন স্থানীয় কৃষক সমবায় সমিতি। সেচ পাম্পের জায়গা নিজের দাবি করে সেখানে তালা দিয়ে রেখেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য। জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বে সেচ ব্যবস্থা অচল করে দেওয়ার কারণে প্রায় ২০০ বিঘা জমির বোরো আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একই ভাবে আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নে স্থানীয় দুজন প্রভাবশালী দখলদারের কারণে গোটা একটি খাল তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। ফলে শত শত বিঘা কৃষি জমির পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে যার কারণে কৃষক তার জমির সময়োপযোগী ব্যবহার এবং ফসলের সম্ভাব্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফয়দা নিচ্ছে ভূমিদস্যু ও আবাসন ব্যবসায়ীরা। এদের নজর শহরের চারপাশের জমির ওপর যে গুলোর অধিকাংশই আবাদি বা আবাদযোগ্য কৃষি জমি। এই ব্যবসায়ীরা প্রভাব বিস্তার করে, আবার কখনও নামমাত্র মূল্যে কৃষকের জমি হাতিয়ে নেয়। সেখানে একটা আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। তারপর আশেপাশের জমিগুলো গিলে খেতে শুরু করে
জীবন ও জীবিকা অর্জনের পথকে কষ্টকর করে তোলার ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের এই ক্ষমতা চর্চা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে গেলে পরিস্থিতিকে অবমূল্যায়ন করা হবে। গ্রামীণ অবকাঠামোতে এসব ঘটছে আর এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক এবং গ্রামীণ অর্থনীতি।
মূল বিষয়ে আসা যাক। আমরা কৃষি জমি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ার কথা বলছিলাম। এখানেও ক্ষমতার খেলা আছে। আছে ভূমিদস্যু, বালুখেকো আর মাটিখেকোদের উৎপাত। আরও আছে অদূরদর্শী ইজারা প্রথা, আইন ও বিধিমালার দুর্বলতা।
দেশজুড়ে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফয়দা নিচ্ছে ভূমিদস্যু ও আবাসন ব্যবসায়ীরা। এদের নজর শহরের চারপাশের জমির ওপর যে গুলোর অধিকাংশই আবাদি বা আবাদযোগ্য কৃষি জমি। এই ব্যবসায়ীরা প্রভাব বিস্তার করে, আবার কখনও নামমাত্র মূল্যে কৃষকের জমি হাতিয়ে নেয়। সেখানে একটা আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। তারপর আশেপাশের জমিগুলো গিলে খেতে শুরু করে। আমরা এদের সাইনবোর্ড দেখেছি কাঞ্চনপুর, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সড়কের দুই পাশে, মাওয়াঘাট এক্সপ্রেসওয়ের দুইপাশে, এবং দেশের অন্যান্য এলাকায়ও। আবাসন প্রকল্পের কারণে প্রকল্পসংলগ্ন জমির দাম বেড়ে যায় ফলে অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র কৃষক আর্থিক লাভের আশায় স্বেচ্ছায় তার ফসলী জমি ছেড়ে দেয়। দিনশেষে এই ভাবে কি পরিমাণ কৃষিজমি আবাসন ব্যবসায়ীদের থলিতে যাচ্ছে সেই হিসাব রাখা কঠিন।
কৃষি জমি বিনাশ প্রক্রিয়ায় ইটভাটার ভূমিকাও লক্ষ্যণীয়। বছরের পর বছর চেষ্টা করেও ইটভাটার ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি সরকার। যদিও এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আইন পাস হয়েছিল ২০১৩ সালে। আইনটা ইটভাটা স্থাপনার পরিমাণ ও মান নিয়ন্ত্রণে কতটুকু পরিবর্তন আনতে পেরেছে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ আইন পাস হওয়ার এক দশক পরও অবৈধ ইটভাটাগুলো এখনও তাদের কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। হিসাব মতে, ২০২২ সাল নাগাদ সারা দেশে মোট ৭,৮৮১টি ইটভাটা সচল ছিল যার ৬০ শতাংশই অবৈধভাবে স্থাপিত এবং পরিচালিত হয়েছে। এই সব ইটভাটার জন্য মাটির যোগান আসে স্থানীয়দের জমি থেকে। আর ইট পোড়ানোর জ্বালানি আসে স্থানীয় বনজঙ্গল থেকে। এই ইটভাটাগুলো শুধু ফসলী জমি নষ্ট করছে না, বনজঙ্গলও উজাড় করছে, পাশাপাশি পরিবেশও মারাত্মকভাবে দুষিত করছে। এটাও দেখা গেছে যে প্রতিবছর একশ্রেণির প্রভাবশালী ভাটা মালিক ভাটায় ইট তৈরির জন্য ছলেবলে কৌশলে কৃষকের জমি থেকে উপরিভাগের মাটি কেটে নেয়। উপরের মাটি কেটে ফেললে জমির পুষ্টি উপাদান কমে যায় এবং এটি স্বাভাবিক হতে সময় নেয় ২৫ থেকে ৩০ বছর। এই ভাবে কত কৃষি জমি উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে তার সঠিক তথ্য নাই। ঝিনাইদ কৃষি বিভাগের তথ্যমতে গত পাঁচ বছরে জেলার আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৪ হাজার ৬৫৩ হেক্টর। অতিসম্প্রতি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় তিন নেতা অবৈধভাবে জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশি বাধায় তাদের প্রচেষ্ঠা প্রতিহত করা হয়েছে। তবে মাটিখেকোদের হামলা থেমে নেই, চলছে। কিছু ঘটনার খবর আমাদের কানে আসে আর অনেকটাই হয়তো আসে না।
পরিশেষে, আমাদের যে পরিমাণ আবাদী জমি আছে সেটা ধরে রাখতে হবে। এই জমি এভাবে হ্রাস পেতে থাকলে দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন এবং যোগানে মারাত্মক ভাটা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর উৎপাদন কমে গেলে আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে, প্রচুর বিদেশি মুদ্রা গচ্ছা যাবে, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে থাকবে। ঘাটতি পুরণের জন্য অন্য দেশ থেকে যে প্রয়োজন মাফিক খাদ্যশস্য আমদানি করা যাবে সেটাও যে সহজ হবে না গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা সেটা বুঝতে পেরেছি বৈকি।
রাষ্ট্রের পাশাপাশি কৃষি জমি রক্ষার দায়িত্ব কৃষককেও নিতে হবে। মাঠ-পর্যায়ের কৃষক সংগঠন ও সমবায়গুলোকে গণতান্ত্রিক ভাবধারায় শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে যেখানে প্রকৃত কৃষকের নেতৃত্ব এবং আধিপত্য থাকবে। একইভাবে কৃষিজমি সুরক্ষা আইন, এতদসংক্রন্ত বিধিমালা, ইটভাটা স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ আইন, পরিবেশ আইনগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে গতিশীল করার প্রয়োজন রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ, কথাসাহিত্যিক।