
‘ডিএমসিবি’ স্বনির্ভর মানুষ তৈরির প্রতিষ্ঠান: নার্গিস আক্তার
- সাক্ষাৎকার
- নভেম্বর ১৩, ২০২৩
স্বনির্ভরতায় ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে যে স্বাধীনতা— বাংলাদেশে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে তার বীজ বপনে ব্যস্ত ডিএমসিবি। প্রায় চার হাজার দক্ষ কর্মী এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ১৪২টি ব্রাঞ্চ নিয়ে ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক’ এদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে চলেছে। দারিদ্র্য বিমচনে অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অর্জন করেছে সাধারণ মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসা। পেয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নয়ন কর্মকান্ডের স্বীকৃতি ও সম্মাননা। এই পথ চলায় অনেক জীবনযুদ্ধ জয়ীদের একজন কাউলা বাজারের নার্গিস আক্তার। তিনি বলছেন কী ছিল তার দারিদ্র্য জয়ের হাতিয়ার। আজকের আত্মবিশ্বাসী নার্গিস আক্তার মাত্র ১৪ বছর বয়সে জীবনের স্বাভাবিক কক্ষপথ হারিয়েছিলেন স্বভাবজাত কিশোরীয় ভুলে। বিয়ের প্রথম দিকে নিজে চাকরি করে সংসার চালিয়েও বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। দু’টাকা বাঁচানোর জন্য হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। বিপরীতে স্বামীর কাছ থেকেই মিলেছে সবচেয়ে বেশি নোংরা কথা। গোলাপের বাগানে কাঁটার চাষ হতে দেখে নার্গিস আক্তার সিদ্ধান্ত নেন একলা চলার। কখনও চাচার কাছ থেকে, কখনও যে দর্জির দোকানে কাজ করতেন তার মালিকের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছেন। বারবার প্রতারিত হয়ে তিনি নিজের একটি ব্যবসার কথা ভাবলেন। ‘পূর্বা’র পাঠকের জন্য তার এই জীবনজয়ের কথাগুলো তুলে ধরা হলো। বি.স
সাধারণত আমাদের সমাজে নারীদের কাজ করার কথা আসলে তারা কোনো চাকরীর কথাই চিন্তা করে। আপনি কেন ব্যবসার কথা চিন্তা করলেন?
নার্গিস আক্তার: সত্যি কথা বলতে কি, আমি এর আগেও দুয়েক জায়গায় চাকরি করেছি। কিন্তু চাকরি করতে করতে আমার একটা কথা মনে হলো যে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে বা জীবনের মান উন্নয়ন করতে গেলে চাকরির মাধ্যমে সম্ভব না। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা তাদেরকে মানুষ করা এবং বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন সেটার জন্য ব্যবসার বিকল্প নেই। চাকরি করে হয়তো টিকে থাকতে পারবো কিন্তু ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো না, তাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারব না। তাই জীবনকে পরিবর্তনের জন্য আমি ব্যবসায় এসেছি।
ছেলেমেয়ের কথা বলছেন, স্বামী এবং তার সাথে সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা একটু জানতে চাই।
না. আ. আমার জীবনে আমি একটা ভুল করে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ক্লাস এইটে থাকতে একজনকে বিয়ে করি। সেই বিয়ে করার কারণে আমার ফ্যামিলির সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়; তারা আমার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। স্বামী আমার থেকে ১৫ বছরের বড়। শুরু হলো সংসার। শুধু সংসারই শুরু করিনি সেই সাথে শুরু করলাম জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ; বেঁচে থাকার যুদ্ধ; না খেয়ে থাকার যুদ্ধ। স্বামীর আসল রূপটা তখনই ধরে ফেললাম, সে ছিল আসলে একজন প্রতারক। পড়ালেখা করেছে মাত্র এসএসসি পর্যন্ত আর বাংলাদেশ বিমানে চাকরির কথাটা ছিল মিথ্যা। সত্যটা জানতেই ভেঙে মুষড়ে পড়লাম। তবু সাহস হারালাম না। স্বামী বাসায় শুয়ে বসে থাকে। অগত্যা আমি চেষ্টা চালিয়ে গার্মেন্টস-এ একটা চাকরি পেলাম। কিন্তু সে চাকরি বেশি দিন করতে পারলাম না, কারণ ডিউটিরত অবস্থায় একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। দীর্ঘ দিন ঠিক মতো না খেতে পেয়ে শরীরে দেখা দিয়েছিল রক্তশূন্যতা। এরপর বাসায় কিছুদিন থাকার পর আবার চাকরি খুঁজতে শুরু করলাম অনেকটা একাই। কারো কারো কাছ থেকে পেলাম চাকরির বিনিময়ে কুপ্রস্তাব। নিজের গহনা বিক্রি করে পরিচিত এক আঙ্কেলকে দিয়ে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করি। তিনিও সেই গহনার টাকাটা মেরে দেন।
প্রথম সন্তানের জন্ম হয় কত সালে?
না. আ. ১৯৯৫ সালে আমি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিই। সেই সাথে অনেক অভাব অনটনের মধ্যেও চালিয়ে যাওয়া পড়ালেখার একটা স্বীকৃতি পেলাম এসএসসি পাসের মাধ্যমে। তারপর অনেকটা নিজের প্রচেষ্টায় সিদ্ধেশ্বরী রোডে একটি টিভি কোম্পানিতে চাকরি পাই, বেতন ১ হাজার ২৫০ টাকা। সেই থেকে শুরু হলো আমার নতুন সংগ্রামের।
আপনার স্বামী কী করতো?
না. আ. সংসারে ভাতের কষ্ট কমলেও স্বামী দিন দিন সংসারের প্রতি আরো বেশি উদাসীন হয়ে যেতে থাকে। আমার বিষয়ে সে এতোটাই অবহেলা করতো যে, আমি প্রায়ই ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত ১১/১২টা বেজে গেলেও বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাকে আনতে পর্যন্ত যেত না। তখন আমরা থাকতে শুরু করেছি ঢাকার দক্ষিণ খানের কাউলা বাজারে। কিন্তু এই দূর্গম পথে প্রায়ই আমাকে একা ফিরতে হতো। তাতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বরং সে বিভিন্ন ভাবে আমাকে দোষারোপ করতো। নিজের অপরাধ ঢাকতে সে প্রতিনিয়ত আমার ওপর অত্যাচার করতে শুরু করে। ২০০৬ সালে চাকরি ছেড়ে কাউলা বাজারে একটি ইলেকট্রিকের দোকান দিই। প্রথম দিকে ব্যবসা জমে গেলেও পরে স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতা ও চরম অবহেলার শিকার হয়ে মুখ থুবড়ে পড়া ব্যবসাটি বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিই।
ব্যাংক কোন ‘জিরো’র ওপরে বিনিয়োগ করতে রাজি নয়। আর অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়াটা অনেকটা তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো, অর্থাৎ যার আছে তাকেই দেবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ডিএমসিবি, তারা আমাকে ‘জিরো’ থেকে ‘হিরো’ হতে সাহায্য করেছে। আমার আজকের ‘হিরো’ হওয়ার পেছনে ডিমসিবি’র কৃতিত্ব অনেক অনেক বেশি
সংসার, বিচ্ছেদ এবং ওই সময়ের কঠিন পরিস্থিতি সম্পর্কে বলবেন?
না. আ. ২০০৮ সালে স্বামী আমাকে ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে যায়। আমি নিজের ও দুটি সন্তানের জীবন বাঁচাতে নতুন যুদ্ধে নামলাম। বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসি। সেই টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে কাউলা বাজারের একটি লেডিস টেইলার্সে কাজ শুরু করি। আর ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করে অবশেষে তাকে তালাক দিয়ে দিই, এবং নিজের গচ্ছিত কিছু টাকা দিয়ে কাউলা বাজারেই শুরু করলাম আমার নিজের প্রথম ব্যবসা ‘নাজ টেইলার্স এন্ড ফেব্রিক্স’। দোকানের অগ্রীম বাবদ খরচ, ডেকরেশন, মেশিন ইত্যাদি খরচের পর দোকানে কাপড় তোলার মতো যথেষ্ট পুঁজি আমার ছিল না। তাই আমার ব্যবসা তখন খুব ভালো চলছিল না। কারণ শুধু কাপড় সেলাই করে ব্যবসা জমানো খুব কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল। ব্যাংক ঋণের কথা ভাবতে থাকি। এরপর কয়েকটি ব্যাংকে ধরণা দিয়েও আমি ঋণ পাইনি। কারণ ঋণ পেতে যে ডকুমেন্টস লাগে তা আমার ছিল না। তখন হঠাৎ আমার মাথায় আসে ডিএমসিবি’র কথা। কারণ আমি পূর্বে যে দোকানটিতে কাজ করতাম সেটিতে ডিএমসিবি’র বিনিয়োগ চালু ছিল। তাই আমি একদিন সরাসরি ডিএমসিবি’র এয়ারপোর্ট শাখাতে গিয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের সাথে দেখা করি। আমি তাকে আমার অবস্থা বলি। তিনি সব শুনে আমাকে বিনিয়োগ প্রদানের আশ্বাস দিলেন। এরপর আমি এই প্রতিষ্ঠানটিতে সদস্যপদ গ্রহণ করি। কয়েক দিনের মধ্যে আমি সহজ শর্তে প্রথম বার ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ পাই। ব্যস, আমার ভাগ্যের চাকায় লাগে নতুন গতি। দোকানে নতুন কাপড় তোলার ফলে দোকানে প্রচুর ক্রেতা আসতে শুরু করল। আর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আমার ব্যবসা দারুণ জমে উঠল।
চাকরি হোক বা ব্যবসা হোক আমাদের সমাজের সাধারণত নারীদের কাজ করার ব্যাপারটাকে ভালোভাবে দেখা হয় না। তো আপনি যে পুরুষের পাশাপাশি ব্যবসা করছেন এখানে কোনো ধরনের সমস্যা অনুভব করেছেন?
না. আ. আসলে যেকোনো কাজ করতে গেলেই বাধা আসে। আর একজন নারী হিসেবে বাধাটা হয়তো একটু বেশি আসে। আমার ক্ষেত্রে যে কিছু বাধা ছিল না এমনটা না, তবে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সেই বাধাকে আমার কাছে কোনো বাধা’ই মনে হয়নি। ব্যবসা করতে গিয়ে যে বাধাটাকে আমার কাছে সবচেয়ে প্রধান মনে হয়েছে সেটা হলো পুঁজির অভাব বা অর্থের সংকট। তবে মহান আল্লাহ’র রহমতে এবং ডিএমসিবি’র সাহায্যে আমি সেই বাধাটা খুব ভালো ভাবেই অতিক্রম করতে পেরেছি।
লোন বা বিনিয়োগ যেটাই বলি না কেন মানুষ তো সবার আগে ব্যাংকে যাওয়ার কথা চিন্তা করে। কিন্তু আপনি ডিএমসিবি’র কথা চিন্তা করলেন কেন?
না. আ. আসলে আমি আজকে যা’ই হয়েছি বা আমার যা’ই আছে না কেন ব্যবসার শুরুতে আমি তো ছিলাম ‘জিরো’। ব্যাংক কোন ‘জিরো’র ওপরে বিনিয়োগ করতে রাজি নয়। আর অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়াটা অনেকটা তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো, অর্থাৎ যার আছে তাকেই দেবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ডিএমসিবি, তারা আমাকে ‘জিরো’ থেকে ‘হিরো’ হতে সাহায্য করেছে। আমার আজকের ‘হিরো’ হওয়ার পেছনে ডিমসিবি’র কৃতিত্ব অনেক অনেক বেশি।
আমাদের সমাজে তো ঘুষ নামক একটা ব্যাপার প্রচলিত আছে। আপনি যে ডিএমসিবি থেকে এতবার বিনিয়োগ গ্রহণ করলেন কখনো কি কাউকে কোনো ধরনের ঘুষ প্রদান করা লেগেছিল?
না. আ. যেহেতু আমি এই সমাজেই বাস করি তাই সমাজের এই চিত্রটা আমার কাছেও স্পষ্ট। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখলাম এই ডিএমসিবি’কে! আমার থেকে কোনো ধরনের ঘুষ কোনো ধরনের সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা তাদের কেউই করে নাই। আমি আমার প্রয়োজন মতো বিনিয়োগটা পেয়েছি।
আমাদের সমাজে পুরুষ নারীদেরকে অলস করে রাখতে চায়, আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাও অলসতার কারণে কোনো কাজ করতে চায় না, নিজেদেরকে ঘরের ভিতরে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। প্রতিটা নারী যেন নিজের যোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজে নিজেদের কাজ খুঁজে নেয়, নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেয়। যদিও আমরা নারীরা পুরুষের সংসার করি তবু আমরা নিজেদেরকে পুরুষের চেয়ে কম মনে করি না বরঞ্চ নিজেদেরকে তাদের সমতুল্যই মনে করি
এই বিনিয়োগ গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনি যত টাকা প্রত্যাশা করেছেন বা যত টাকা তাদের কাছ থেকে চেয়েছেন ঠিক তত টাকাই পেয়েছেন? নাকি কখনো কম পেয়েছেন?
না. আ. আমি কখনোই কম পাইনি। বরং তারা আমাকে আরো বেশি নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করে; তারা আমাকে সব সময়ই বলে, আপনার লাগলে আরো বেশি নেন আপনার ব্যবসা আরো বৃদ্ধি করেন। কিন্তু আসলে আমি আমার প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়েছি; যতটুকু আমার দরকার যতটুকু আমার ক্যাপাসিটি যতটুকু আমি পারবো ততটুকুই নিয়েছি। কিন্তু তারা কখনোই আমাকে কম দেওয়ার চেষ্টা করেন নাই। বরং বিনিয়োগ গ্রহীতারা যেন তাদের ব্যবসা আরো বড় করতে পারে সেই চেষ্টাটা আমি তাদের ভিতরে দেখেছি।
আপনি এখন যে কিস্তি পরিশোধ করছেন কিস্তির এই পরিমাণটা কি ডিএমসিবি নির্ধারণ করে দিয়েছে, না আপনি নিজে নির্ধারণ করেছেন?
না. আ. কিস্তি পরিশোধের এই পরিমাণটা আমি নিজেই নির্ধারণ করেছি। ডিএমসিবি’র কর্মকর্তারা আমাকে শুধু দেখিয়েছে কিভাবে কতটুকু পরিশোধ করতে হবে। সেই হিসাবটা দেখে বুঝে আমি নিজেই নির্ধারণ করেছি যে আমি প্রতিদিন কতটুকু কিস্তি পরিশোধ করব।
এখন আপনি প্রতিদিন যে কিস্তি পরিশোধ করছেন সেই টাকাটা কি আপনি আপনার লাভ থেকেই দিচ্ছেন না কি আসল থেকেও কোনো টাকা দেওয়া লাগছে?
না. আ. আমি এখন যে কিস্তি পরিশোধ করছি এটা পুরোটাই আমার লাভ থেকে করছি। আপনি এটাকে গ্রাম বাংলার ভাষায় এভাবেও বলতে পারেন ‘মাছের তেল দিয়েই মাছ ভাজা’। আমি এইভাবেই আগাচ্ছি। আমি আমার লাভ থেকেই দিচ্ছি; আমার পুজিও নষ্ট করছি না আমার বাড়ির জমিও বিক্রি করছি না।
গত বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ২০২২ পর্যন্ত আপনাদেরকে সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধ করতে হতো ছয়টি, আর ২০২৩-এর জানুয়ারি থেকে কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে পাঁচটি; এই হিসাবে দেখা গেছে যে, এক লাখ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ১ বছরে ১৬০০ টাকা কম দেওয়া লাগছে। এই ব্যাপারটা বিনিয়োগ গ্রহীতাদেরকে কতটুকু উৎসাহিত করবে বলে মনে করেন?
না. আ. আসলেই এই ব্যাপারটা আমাদেরকে অনেক উৎসাহ দেয়। একটা দিন কিস্তি কম দেওয়ার এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে অনেক আনন্দের। মনে হয় যেন সারা বছর কষ্ট করলাম আর রমজানে এক মাস সেটার আনন্দ ভোগ করলাম।
ডিএমসিবি একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের চিন্তা করছে যে, ‘ডিএমসিবি তার কোন সদস্যের নামে মামলা করবে না’। এই যে মামলা না করার সিদ্ধান্তটা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে বলে মনে করেন?
না. আ. আমার মনে হয় এটা হবে একটি মানবিক পদক্ষেপ। তবে আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ‘কেস’ দরকারও আছে। আমি যতদূর জানি আমাদের এই প্রতিষ্ঠান অনেক বড় হয়েছে অনেক আগাইছে। মানুষের সেবা করার প্রত্যয় তাদের আছে। মানুষের সেবা করার সক্ষমতা তাদের আছে। এখন যদি মামলা ব্যাপারটা তারা উঠিয়ে নেয় সেটা আসলে সমাজের জন্য হবে একটি ভালো ম্যাসেজ। সত্যি বলতে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কেউ ইচ্ছে করে খেলাপি হতে চায় না। দু’একজন ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু বেশিরভাগই চায় না যে ইচ্ছে করে খেলাপি হোক এবং ইচ্ছে করে হয়রানির মধ্যে পড়ুক।
আপনি সর্বমোট কত বার বিনিয়োগ গ্রহণ করেছেন?
না. আ. আমি ১০ বার বিনিয়োগ গ্রহণ করেছি এবং সময় মতো তা পরিশোধও করেছি। আমার চলমান বিনিয়োগটি ৯ লক্ষ টাকার।
আপনার বর্তমান অবস্থান নিয়ে বলুন।
না. আ. একটি দোকান থেকে আমি আরো একটি দোকান ও একটি কারখানা স্থাপন করেছি। দোকানে ৭ জন কর্মচারীর কর্মসংস্থান করতে পেরেছি। বর্তমানে ব্যবসায় আমার মূলধন কোটি টাকার কাছাকাছি। আমি এই দোকানের আয় থেকে আমার বড় ছেলেকে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করিয়েছি। বর্তমানে সে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে এবং মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।
সারাটি জীবন আমি অনেক মানুষকে বিশ্বাস করেছি, কিন্তু প্রায় সবার দ্বারাই প্রতারিত হয়েছি। শুধুমাত্র ডিএমসিবি আমাকে বিশ্বাস করে মাথার ওপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চাকরি নেই, স্বামী পরিত্যক্তা একজন নারীর ওপর বিশ্বাস রেখেছিল ডিএমসিবি। আমি আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানটির কথা মনে রাখব। সারা জীবনে পাওয়া কষ্ট থেকে শেখা একটি বিষয় আমি মানসিকভাবে স্থির করে নিয়েছি যে, আমি আমার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের অসহায়, নিরুপায়, স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীদের পাশে দাঁড়াব। তাদেরকে আমার এই কাজ শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা করব। আর আমি বিশ্বাস করি যে, ডিএমসিবিও তাদেরকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে, ঠিক যেমন আমার কঠিন সময়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
আপনার সামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আপনি দোকানের পাশাপাশি কারখানাও করছেন দেখলাম; তো আপনি আপনার এখনকার যে সামাজিক অবস্থা সেটা নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট?
না. আ. মহান আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলছি যে, আমি আমার বর্তমান সামাজিক অবস্থা নিয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্ট। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে কখনও আমি শেষ করতে পারবো না। আল্লাহ’র রহমতে আমার মতো একজন মানুষ আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছে। এরপরে আমি কৃতজ্ঞ ডিএমসিবি’র কাছে যারা আমাকে আমার শুরু থেকে নানা সময়ে বিভিন্ন বুদ্ধি পরামর্শ আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী যে আমি আমার অবস্থানকে আরো অনেক ওপরে নিয়ে যেতে পারবো। সেই বিশ্বাস সেই পথনির্দেশনা আমি পেয়েছি।
আপনি অনেকবার ডিএমসিবি’র কথা বলেছেন; ডিএমসিবি নিয়ে আপনার মতামতটা একটু জানতে চাই।
না. আ. ডিএমসিবি হলো স্বনির্ভর মানুষ তৈরির প্রতিষ্ঠান। যাকে বিশ্বাস করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে মাথা তুলে দাঁড়াবার আত্মবিশ্বাস, তাদের পরিবার পাচ্ছে স্বচ্ছলতার দেখা, ছেলে-মেয়েরা পাচ্ছে যথাযথ শিক্ষার আলো, সমাজ দেখছে দারিদ্র্র্র্য মুক্তির পথ।
আপনি তো একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। নারীদের জন্য আপনার উপদেশ।
না. আ. আমি বলতে চাই নারীরা যেন ঘরের চার দেয়ালের ভিতরে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে না রাখে। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার চিন্তা থেকে নারীরা যেন বের হয়ে আসে। আমাদের সমাজে পুরুষ নারীদেরকে অলস করে রাখতে চায়, আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাও অলসতার কারণে কোনো কাজ করতে চায় না, নিজেদেরকে ঘরের ভিতরে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। প্রতিটা নারী যেন নিজের যোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী সমাজে নিজেদের কাজ খুঁজে নেয়, নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেয়। যদিও আমরা নারীরা পুরুষের সংসার করি তবু আমরা নিজেদেরকে পুরুষের চেয়ে কম মনে করি না বরঞ্চ নিজেদেরকে তাদের সমতুল্যই মনে করি। তাই ঘরের কোণে আবদ্ধ না থেকে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করা উচিত। আমি তো মনে করি নারীদের ভিতরে জিদ থাকলে তারা পুরুষের চাইতেও বেশি সফল হতে পারে।
আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
না. আ. আপনাকেও ধন্যবাদ।