দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি

দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি

যেহেতু ‘কালো টাকা’ (Black Money) ও ‘অর্থ পাচার’ (Money Laundering) উভয়েরই মূলে আছে ‘দুর্নীতি’ (Corruption), সেহেতু মূল দিয়ে শুরু করলে যৌক্তিক কারণেই ‘দুর্নীতি’ দিয়েই শুরু করতে হবে। এ উপ-পরি অধ্যায়ে আমরা সেটাই করব রাজনৈতিক অর্থনীতির নিরিখে। শোভন সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ, বিধায় প্রত্যেকটি বিষয় বোধগম্যতার সুবিধার্থে ভিন্নভাবে আলোচনা করব। তবে যেহেতু বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কিত, সেহেতু ভিন্ন আলোচনায়ও প্রয়োজনীয় যোগসূত্র উদ্ঘাটনের প্রয়াস থাকবে।

কালো টাকার অর্থনীতি (Economics of Black Money) ও অর্থ পাচারের অর্থনীতি (Economics of Money Laundering) উভয়ই ‘দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি’র (Politcal Economy of Corruption) অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যদি তা-ই হয়, তাহলে দুর্নীতির (Corruption) একটা কার্যকর সংজ্ঞা অথবা ধারণাকাঠামো বিনির্মাণ জরুরি (যদিও কাজটি জটিল)। বড় পর্দায় দুর্নীতি বলতে আমরা সবাই বুঝি নীতিগর্হিত কিছু একটা অথবা বুঝি সেই প্রক্রিয়া অথবা কাজ (act অর্থে) যা বিশ্বাস বা আস্থা-লঙ্ঘন করে (violation of trust) । আর এই আস্থা-বিশ্বাস লঙ্ঘনের পেছনে নিঃসন্দেহে কোনো  না কোনো ‘অনুপ্রেরক’ কাজ করে। দুর্নীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। দুর্নীতি যদি হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের অন্তঃজাত- অন্তর্নিহিত (inherent অর্থে) প্রাকৃতিক বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে দুর্নীতির উৎস কারণ অনুসন্ধান অমূলক হবে। সেক্ষেত্রে মেনে নিতে হবে অ্যাডাম স্মিথের (১৭২৩-১৭৯০) ‘প্রাকৃতিক স্বাধীনতাভিত্তিক ব্যবস্থা’ (system of natural liberty) বিশ্বাসতত্ত্বে। যে বিশ্বাসতত্ত্ব বলে যে (১) ‘প্রত্যেক মানুষকে তার স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ দিলে তা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্যই সর্বোত্তম পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি করবে’, ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায়ও সামাজিক শৃঙ্খলা-সংহতি গড়ে উঠবে’, (২) ‘এক অদৃশ্য হাত বাজারব্যবস্থার মধ্যস্থতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে উন্নতি নিশ্চিত করবে’, (৩) ‘সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাটা একাধারে প্রাকৃতিক এবং প্রয়োজনীয়’, (৪) ‘পণ্য প্রথা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে, এটা তার স্বভাবজাত’। অ্যাডাম স্মিথের এসব কথা ঠিক হলে দার্শনিক টমাস বেকন (১৫১২-১৬৬৭) অর্জনপ্রবণ-মুনাফাকেন্দ্রিক-ক্রয়-বিক্রয়প্রধান অর্থনীতি দেখে যে বললেন ‘যেসব ব্যক্তি নিজেদের ব্যক্তিগত মুনাফার অনুসন্ধানে লিপ্ত তারা হলেন লোভী, মেষপালক আর রাখাল স্বভাবের ভদ্রলোক’‒ এ কথার কী হবে? কী হবে দার্শনিক ডেভিড হিউমের (১৭১১-১৭৭৬), যিনি বললেন যে ‘সম্পত্তির অধিকার (ব্যক্তিগত মালিকানা) কোনো প্রাকৃতিক অধিকার নয়?’ কী হবে কার্ল মার্ক্সের (১৮১৮-১৮৮৩) উত্তরণশীল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার তত্ত্বের, উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের, শোষণ-বিচ্ছিন্নতা-অর্থনৈতিক স্বার্থসহ শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের, পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থার প্রাকৃতিক অবসানের তত্ত্বের, পুুঁজিবাদে পণ্য উৎপাদনের সর্বজনীনতার তত্ত্বের, পণ্যের বিনিময়মূল্য নিরূপণে বিমূর্ত শ্রমের তত্ত্বের, সম্প্রসারিত পুনরুৎপাদন তত্ত্বের? এসব বিশ্লেষণে না গিয়ে সরাসরি বলা সংগত যে ‘স্বার্থপরতা’, ‘নিজস্বার্থ’ স্ব-স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা, অর্থপূজা হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের স্বভাবজাত নয় এবং নয় তা প্রাকৃতিক। উল্টো ‘স্বার্থপরতা’ হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো যৌথভাবনা, যৌথচিন্তা, যৌথশ্রম, যৌথ উৎপাদন, যৌথসমাজ। সুতরাং দুর্নীতি হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের সহজাতও নয় এবং নয় তা প্রাকৃতিক।

দুর্নীতির অর্থনৈতিক (economic) ও সামাজিক (social) দিক নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। কোনো গবেষণাতেই ‘দুর্নীতির’ সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায় না; পাওয়া যায় না দুর্নীতির ‘কারণ-পরিণাম’ সম্পর্ক। ‘দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি’ (Political economy of corruption) নিয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান গভীর ভাবনা নেই বললেই চলে। দুর্নীতি কী;  দুর্নীতির সংজ্ঞাটা দিচ্ছে কে; কারা কোন দুর্নীতি করে; পেটি দুর্নীতি আর মহাদুর্নীতি এক কিনা; সমাজ-অর্থনীতিতে এসবের অভিঘাত ও ক্ষতিমাত্রা এক কিনা; দুর্নীতির সঙ্গে পরজীবী-বিত্তশালী শ্রেণির (অর্থাৎ ‘রেন্ট-সিকার’) সম্পর্ক কী‒ এসব বিষয় নিয়ে চিন্তায় দৈন্য আছে। তবে সহজ যুক্তির কথা হলো‒ যদি বিত্ত ‘সৃষ্টি’ না করে বিত্তবান হওয়া যায়, তাহলে সে পথ নয় কেন? এটাই দুর্নীতির, এটাই রেন্টসিকিংয়ের অন্যতম রূপ।

দুর্নীতির অর্থনৈতিক (economic) ও সামাজিক (social) দিক নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। কোনো গবেষণাতেই ‘দুর্নীতির’ সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায় না; পাওয়া যায় না দুর্নীতির ‘কারণ-পরিণাম’ সম্পর্ক। ‘দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি’ (Political economy of corruption) নিয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান গভীর ভাবনা নেই বললেই চলে

আধুনিক সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রের এমন কোনো খাত-ক্ষেত্র নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। সমাজের অন্তঃস্থ বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কের মধ্যে নীতিহীনতা অথবা নীতিগর্হিত বিষয়াদি খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। দেড়শ বছর আগে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসেও তো বিয়ের ঘটকের বচনে পাওয়া যাবে ‘হবু জামাই বাবু মস্ত বড় চাকুরি করেন, ভালো মাইনে তার, উপরিও আছে’। দরিদ্র কৃষক সলিমুদ্দি-সখিনা-যদু-মধু তারা সবাই তাদের শ্রম-উৎপাদিত কৃষিপণ্য তুলনামূলক সস্তায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন‒ অর্থাৎ কৃষক দুর্নীতি করতে পারেন না, তার পণ্য নিয়ে দুর্নীতি করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য গার্মেন্টস-টেক্সটাইলসহ সবধরনের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যদি তারা শোষণভিত্তিক উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির কোনো কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হন। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বহু ধরনের দুর্নীতি করেন (পরে আসছি), মুদিখানার দোকানদারদেরও হিসাবরক্ষণে একাধিক খাতা থাকে (আসল খাতা-নকল খাতা)। বিভিন্ন পেশার মানুষ কম-বেশি নীতিভ্রষ্ট হন‒ দুর্নীতি করেন (তা আমরা সবাই জানি); এমনকি মহৎ পেশার শিক্ষকও যখন জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান বিতরণে গাফিলতি করেন, সেটাও তো দুর্নীতি। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের (নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ) হেন প্রত্যঙ্গ নেই, যেখানে দুর্নীতি নেই। বাংলাদেশের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া তার মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছেন (২০০৭ সালে) ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি কারণ যারা সরকারে থাকেন, তারাই দুর্নীতি করেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এটা সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য’। এসবের অর্থ এ-ই নয় যে দুর্নীতি সর্বজনীন (universal)। একটি দেশের কত শতাংশ মানুষ সরাসরি দুর্নীতি করেন এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান পৃথিবীতে আছে বলে আমার জানা নেই (অন্তত আমি অনুসন্ধান করে পাইনি)। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস পৃথিবীতে সময়কাল নির্বিশেষে একটি দেশও পাওয়া যাবে না যেখানে মোট অশিশু-জনসংখ্যার (অর্থাৎ মোট জনসংখ্যায় শিশুদের বাদ দিয়ে, কারণ দুর্নীতি বিচারে তারা প্রযোজ্য নয়) ৫শতাংশের বেশি দুর্নীতি করেন (তুলনামূলক এ সংখ্যাটি হবে ৫ শতাংশের নিচে)। তাহলে দুর্নীতি সর্বজনীন (corruption is universal)‒ এ কথা কোনো দিনই সত্যি ছিল না এবং কোনো দিনই সত্যি হবে না। দুর্নীতি যে মানুষের স্বভাবজাত বিষয় নয়, নয় তা প্রাকৃতিক‒ এসবই নিরঙ্কুশ সত্য (absolute truth); অর্থাৎ দুর্নীতির উৎস খুঁজতে হবে মানুষ যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোতে বাস করে সেখানে, অন্যত্র নয়। অবশ্য বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই দুর্নীতি হ্রাস অথবা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার সম্ভাবনা নিয়ে সংস্কারবাদী চিন্তকদের অনেকেই মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন সমাজচিন্তক-অর্থনীতিশাস্ত্রিক অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন যে বিদ্যমান কাঠামোতেই ‘উচ্চ দুর্নীতি ভারসাম্য’ (high corruption equilibrium) এবং ‘সততার ভারসাম্য’ (‘Ôhonest equilibrium’)‒ এ দুয়ের মধ্যবর্তী একটা অবস্থান থাকা সম্ভব, যা দুর্নীতিকে প্রণোদিত করা ও না করার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করতে সক্ষম; এবং ‘দুর্নীতির ফাঁদ’টা (corruption trap) এমন যে একটা ক্রিটিক্যাল সীমা ছাড়ালে বিষয়টি হয়ে দাঁড়াবে অনিবর্তনীয়, যার জন্য সমাজকে অপরিমেয় মূল্য দিতে হবে।

একটা উদাহরণ দিই। একজন স্বল্প বেতনভুক্ত অফিস পিয়ন ফাইল এগিয়ে ৫০ টাকা নিলেন। এটা কি দুর্নীতি? নাকি বৈষম্য-অসমতা সৃষ্টিকারী সমাজে পেটের দায়ে কোনোমতে সংসার পরিচালনের জন্য ব্যয় সংকুলানে ‘বাজারের অদৃশ্য হাতের কারসাজি’ আয়ের এক পদ্ধতি (যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর ফলে ওই ব্যক্তিটিও মানসিক স্বস্তিতে নেই)

দুর্নীতির রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মর্মার্থ নিয়ে গুরুত্ববহ তেমন কোনো গবেষণা হয়নি বললেই চলে। দুর্নীতির সাধারণ সংজ্ঞা সবাই জানেন অথবা দুর্নীতি কী সবাই বোঝেন‒ এটা ধরে নিয়েই কালো টাকা ও অর্থ পাচার বিষয়ে যাওয়ার আগে দুর্নীতি নিয়ে দু-একটি বিষয় উত্থাপন জরুরি মনে করছি। আমি এ দেশে দু-ধরনের দুর্নীতি দেখি: পেটি দুর্নীতি (যা ছোট দুুর্নীতি) আর মহাদুর্নীতি (বড় দুর্নীতি)। প্রথমে আসা যাক পেটি দুর্নীতির প্রসঙ্গে। একজন রিকশাচালক ২০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা নিলে আমরা ধরেই নিই যে তিনি (রিকশাচালক) দুর্নীতি করলেন (আরোহী ভদ্রলোক হলে বলবেন‒ ব্যাটা ঠকালো)। আমার প্রশ্ন রিকশা ভাড়াটা যে ৩০ টাকা নয়, ২০ টাকা হবে‒ এটা কে নির্ধারণ করল? বলবেন ‘বাজার’ বা অ্যাডাম স্মিথের ‘বাজারের অদৃশ্য হাত’ (invisible hand of market)। কিন্তু বাজার যখন রেন্ট সিকার-পরজীবী-লুটেরা-বিত্তশালী শ্রেণির কথায় ওঠা-বসা করে তখন? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন কে, কোন প্রতিষ্ঠান, কোন সিস্টেম তার পেশাগত ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল যে তাকে রিকশা চালিয়েই জীবন নির্বাহ করতে হবে?  এসবের মানে হলো কোথাও কোনো ধরনের বড় গলদ আছে? আর আমরা ওই গলদ দেখেও না দেখার ভান করছি (এটাকে বলা হয় denial syndrome)। পেটি দুর্নীতির মাত্রা-রূপ অনেক। এজন্য আরো একটা উদাহরণ দিই। একজন স্বল্প বেতনভুক্ত অফিস পিয়ন ফাইল এগিয়ে ৫০ টাকা নিলেন। এটা কি দুর্নীতি? নাকি বৈষম্য-অসমতা সৃষ্টিকারী সমাজে পেটের দায়ে কোনোমতে সংসার পরিচালনের জন্য ব্যয় সংকুলানে ‘বাজারের অদৃশ্য হাতের কারসাজি’ আয়ের এক পদ্ধতি (যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর ফলে ওই ব্যক্তিটিও মানসিক স্বস্তিতে নেই)। এসব আদৌ রেন্টসিকিং নয়। মহাদুর্নীতির তুলনায় এসব পেটি দুর্নীতির পরিণাম সমাজ-অর্থনীতি-সাংস্কৃতিক জীবনে সম্ভবত তেমন কোনো গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে না। আসলে এসব পেটি দুর্নীতিকে উদ্বুদ্ধ করে বড় দুর্নীতিবাজরাই, যারাই আসল ‘রেন্ট-সিকার’। এই সিস্টেমও তারাই সৃষ্টি করেছেন‒ দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা সৃষ্টি পুনঃসৃষ্টির উৎস সৃষ্টির মাধ্যমে। আসলে বড় মাপের জাতীয় বিধ্বংসী দুর্নীতিবাজরা উপরতলার পরজীবী-বিত্তবান ‘রেন্ট-সিকার’‒ এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। কারণ অন্যের বিত্ত-সম্পদ দখল, বেদখল, জবরদখল, হরণ, গ্রহণ, অধিগ্রহণসহ আত্মসাৎই তাদের মূল পেশা ও নেশা; লোভের লাভ এখানে বড় কথা। এসব ‘রেন্ট-সিকার’ কখনো উচ্চকণ্ঠে বলবেন না ‘দুর্নীতি দূর হোক’ আর সেটা ‘রেন্ট-সিকার’ হওয়ার কারণেই। কারণ সেক্ষেত্রে তাদের অনুপার্জিত-হরণকৃত বিত্তের সিস্টেমটিই ভেঙে পড়বে, আর সেই সঙ্গে বিত্তের বৃহৎ অংশ কর-রাজস্বের প্রগ্রেসিভ নীতির মাধ্যমে হাতছাড়া হয়ে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা হ্রাস করবে। সুতরাং ‘দুর্নীতি’ নিয়ে বড় কথা বলে লাভ নেই। এ কথা বলেও লাভ নেই যে যেহেতু এই দেশে দুর্নীতি এখন একই সঙ্গে অনুভূমিক (horizontal) ও উল্লম্বিক (vertical), সেহেতু অবস্থা খারাপ। দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতার ভিত্তি-কারণ কাঠামোটা ভেঙেই দেখুন না দুর্নীতি কোথায় যায়!

এতক্ষণ যা বললাম তা কিছুটা তত্ত্বকথা বলে মনে হতে পারে। সে কারণেই ‘দুর্নীতি’ নিয়ে ঐতিহাসিক কিছু সত্য বলা প্রয়োজন বোধ করছি। আজকের ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলোর দুর্নীতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের (সপ্তদশ থেকে বিংশ শতকে) কয়েকটি উদাহরণ দিলে সম্ভবত অনেক কিছুই আপাতত পরিষ্কার হবে। কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ :

(১)          আজকের যুগের বেশির ভাগ ধনবান পুঁজিবাদী দেশ যখন সাফল্যের সঙ্গে শিল্পায়নপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সে সময়ে তাদের পাবলিক লাইফ ছিল অতি দুর্নীতিগ্রস্ত।

(২)         অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিটেন ও ফ্রান্সে সরকারি অফিস বেচা-কেনা হতো।

(৩)       ব্রিটেনে ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকেও মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয়ের তহবিল ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক কাজে ব্যবহার করতে পারতেন, যা স্বাভাবিক মনে করা হতো এবং একই সঙ্গে সরকারি উচ্চপদস্থ আমলা নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার পরিবর্তে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অধিকতর গুরুত্ববহ ছিল।

(৪)        মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৮৩ সালে পেনডলেটন আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চিফ হুইপকে (অর্থাৎ মার্কিন কংগ্রেসের মেজরিটি লিডার) ‘ট্রেজারি বেঞ্চের পৃষ্ঠপোষক সেক্রেটারি’ (Patronage Secretary of the Treasury) নামে অভিহিত করা হতো। কারণ নিজ দলীয় ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানই ছিল তার প্রধান কাজ। ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন ফেডারেল সরকারের আমলাদের একজনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিযুক্ত হননি‒ অথচ এ সময়কালেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটে।

(৫)      ভোট জালিয়াতি ও ভোটার কেনা-বেচায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা বহুকাল যাবৎ প্রচলিত স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে বহাল ছিল। ঊনবিংশ শতকে বিচারিক এবং নির্বাচনী দুর্নীতি এমন পর্যায়ে ছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী থিওডর রুজভেল্ট নিউইয়র্ক অ্যাসেম্বলির ভোট কেনা-বেচার লবিস্টদের বলেছিলেন ‘জনজীবন ও সিভিল সার্ভিস হলো এমন কিছু, যার সঙ্গে মৃত ভেড়ার সঙ্গে শকুনের তুলনা করা সংগত’।

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যাপক, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং

সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

আরও পড়তে পারেন

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে নতুন করে আরও প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা…
জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

ঈদুল আজহার আগেই বাজারে ছাড়া হচ্ছে নতুন ডিজাইনের টাকার নোট, যা দুই টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত…
পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

সৌদি আরব হজ পারমিট সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যারা বৈধ…