বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল অগ্রযাত্রার মাইলফলক

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল অগ্রযাত্রার মাইলফলক

পটভূমি

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক বিরানভূমি। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই হাহাকার, জনমানবহীন ভিটে, বাতাসে লাশের গন্ধ, পিতৃ-মাতৃহীন শিশু লাশের ওপর দিয়ে গড়াগড়ি খায়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এলেন। সেদিন অপরাহ্ণে এসে আবার দাঁড়ালেন রেসকোর্সের ময়দানে, যেখানে তিনি ’৭১-এর ৭ মার্চে দাঁড়িয়েছিলেন লাখো জনতার সামনে। সাত কোটি বাঙালিকে আবার তিনি দেশ গড়ার কাজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানালেন।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি আর সংবিধানের সংশোধনী এনে সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন করে নতুন সিস্টেম চালু করলেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি- মাঝে সময় মাত্র তিন বছর কয়েক দিন। এই পরিবর্তনের পটভূমি খুঁজতে হলে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের অতিবাহিত তিন বছর কয়েক দিনের খেরোখাতাটা খুলে দেখতে হবে।

দেশ গঠনের কাজে হাত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে কতগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এক নজরে সেগুলো দেখে নেয়া যাক : মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসিত করা; যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনে স্বস্তি দান করা; মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটককৃতদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করা; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বিপুলসংখ্যক ভারতীয় সৈন্যকে সসম্মানে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো; স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি পাওয়া এবং জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ অর্জন করা; আন্তর্জাতিক অনুদান লাভের চেষ্টা করা; মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দালালদের চিহ্নিত করা এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা প্রভৃতি সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, যে বাঙালি তাঁর কথায় পরস্পর মিলিত হয়ে মৃত্যুমুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করল তারাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দেশ গঠনের কাজে সহযোগিতার বদলে বাধার সৃষ্টি করছে, ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতা করছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্র ও তাদের দেশীয় দোসররা তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে।

সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন দেশের মানুষের বাস্তবতাবিবর্জিত সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার কারণে। দেশের মানুষের মনে হয়েছিল যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কাজেই তাদের অতীতের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা দ্রুত পূরণ হবে। বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। তাদের সামনে ছিল যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, ’৬৬-এর ৬ দফা, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা। শিক্ষার ক্ষেত্রে অবৈতনিক কর্মপ্রণালি, জাতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বৃহৎ কলকারখানা ইত্যাদি জাতীয়করণ, কৃষকের জন্য পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ইত্যাদি রাতারাতি করে ফেলার তাগিদে বঙ্গবন্ধুর সরকার একটা ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এসব করতে যে, ধাপে ধাপে  এগোতে হয় এবং তার জন্য সময় প্রয়োজন ও সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে অপেক্ষা করার প্রয়োজন ছিল সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধৈর্যশীল হতে পারেনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে সবকিছু রাতারাতি প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় যারা বুঁদ হয়েছিলেন তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটার দিকে একবারও তাকানোর অবসর পেলেন না। পাকিস্তানিরা ৪৩ লাখ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, খাদ্যশস্য পুড়িয়ে দেয়, হালের গরু জবাই করে খায়, মাঠের গভীর-অগভীর নলকূপ ধ্বংস করে, যুদ্ধকালীন চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যশস্যের মজুদ বলতে প্রায় কিছু ছিল না। ফলে স্বাধীন দেশের চাষাবাদ শুরু করার মতো হালের গরু, বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদির একটা গভীর সংকটে পড়ে কৃষিক্ষেত্র। উপরন্তু যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের বাস্তুসংস্থানও ছিল একটা কঠিন কাজ।

ইত্যাকার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল দক্ষ জনবল এবং দ্ব্যর্থহীন সহযোগিতা। দক্ষ কাজের লোকেরও অভাব দেখা দেয়। কারণ, বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে শতকরা ৬০ শতাংশ উচ্চপদস্থ ও শতকরা ২০ ভাগ নিম্নপদস্থ অবাঙালি কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়ে রেখেছিল। যুদ্ধের সময় অবাঙালিরা এদেশ থেকে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে ব্যাপকহারে বুদ্ধিজীবী নিধন ও মধ্যবিত্তের যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং শহীদ হওয়ার ফলে দক্ষ প্রশাসক ও কর্মীর অভাব দেখা দেয়। এসব সমস্যা মোকাবেলা জন্য বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়ে জেনেশুনেই কিছু বিতর্কিত লোককে প্রশাসনে মূলযন্ত্রে বহাল করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে সবকিছু রাতারাতি প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় যারা বুঁদ হয়েছিলেন তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটার দিকে একবারও তাকানোর অবসর পেলেন না

সুতরাং অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে না গিয়েও উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যে সরকারের প্রধান হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশের পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছিলেন, তা সহজ ছিল না। কিন্তু কঠিন মনোবল আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি একটি কাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন :

ক. ’৭২-এর ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় বাংলাদেশের পতাকা, জাতীয় সংগীত ও রণসংগীত কী হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন; স্বল্পতম সময়ে (এপ্রিল-ডিসেম্বর, ১৯৭২) জাতীয় চারনীতির ভিত্তিতে সংবিধান রচনার কাজ শেষ হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর করা হয়।

খ. অবাঙালিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিষয়ক আইন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধীদের বিচারের জন্য দালাল আইন প্রণয়ন;

গ. পাকিস্তানি আমলের স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন করে জেলা থেকে গ্রাম পর্যায়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন;

ঘ. যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা এবং ’৭০-এর নির্বাচনি ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বঙ্গবন্ধু জাতীয়করণ কর্মসূচি গ্রহণ এবং এর আওতায় ৬৭টি পাটকল, ৬৪টি বস্ত্রকল এবং ১৫টি চিনিকল প্রাথমিকভাবে জাতীয়করণ ও ১২টি ব্যাংক, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের স্থায়ী সম্পদ রয়েছে এমন সব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আওতায় আনা;

ঙ. ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ এবং পাকিস্তান আমলে আরোপিত ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা বাতিলকরণসহ কৃষিসহায়ক উপকরণ নিশ্চিতকরণ;

চ. শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন প্রভৃতি।

সময়োপযোগী এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও দেশ গঠনের কাজে আশানুরূপ ফল না পাওয়ার কারণ ছিল দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক অহযোগিতা, একই কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা এবং সর্বোপরি পদে পদে বিরোধিতা। অসহযোগিতা ও বিরোধিতার এই প্লাটফর্মে মওলানা ভাসানীর ন্যাপের ছায়াতলে একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সিরাজ শিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, হক তোহা মতিন, আলাউদ্দিন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, অমল সেন প্রমুখের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল, যারা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতার নামে মূলত হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেয়। মওলানা ভাসানী এদের নেতা হয়ে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের সুরে সুর মিলিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘আমি নতুন পতাকা ওড়াবো।’ এই জোটের কেউ বলল, ‘স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ’; কেউ বলল, ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর কথা; কেউ ‘মুসলিম বাংলা’র স্লোগান দিয়ে চীন-পাকিস্তান প্রদত্ত অস্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। প্রতিনিয়ত গুপ্ত হত্যা, অপহরণ, ডাকাতির খবর পত্রিকায় পাতায় প্রকাশিত হতে থাকল। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রণীত ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্ট: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড গ্রন্থের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় : ‘বঙ্গবন্ধু সরকার গঠনের পর হতে; অর্থাৎ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত এক সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, ওই সময়কালে ২০৩৫টি গোপন খুন, ৩৩৭টি কিডন্যাপিং, ১৯০টি ধর্ষণ, ৪৯০৭টি ডাকাতি এবং ৪০২৫ ব্যক্তি ওইসব উগ্রপন্থী দুষ্কৃতকারীর হাতে প্রাণ হারায়।’ [পৃ. ৫৩-৫৮]

এই রকম একটি পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর দেশের অবস্থা সকল দিক থেকেই অনেকটা শান্ত হয়ে এলে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মহান সংসদে প্রদত্ত এক দীর্ঘ ভাষণের মাধ্যমে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি তুলে ধরে দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা ঘোষণা করেন।

 

দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কে প্রথম ভাষণ দেন জাতীয় সংসদে। এর পর থেকে চূড়ান্ত কর্মসূচি তুলে ধরা পর্যন্ত তাঁর প্রদত্ত ভাষণে দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কে যা বলেছিলেন সেগুলো বিশ্লেষণ করলে কতগুলো মৌলিক উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয় :

ক. প্রতিবিপ্লবীদের অপতৎপরতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে সেটা পুনরুদ্ধার করা;

খ. প্রতিবিপ্লবীদের হত্যা, রাহাজানি, লুটপাটের ফলে গণমানুষের মধ্যে যে হতাশা এবং আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল নতুন কর্মের জোয়ারে সেই অবস্থার পরিবর্তন করা;

গ. প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে গণমানুষের সংযোগ সুদৃঢ় করা; এবং

ঘ. বাধ্যতামূলক গ্রাম-সমবায় চালু করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে একটা টেকসই ফর্মে নিয়ে যাওয়া, যাতে করে গণমানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়, সমবায়িক কাজের মাধ্যমে সামজিক সংযোগ অটুট থাকে সর্বোপরি গ্রামপর্যায়ে একটা সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে এবং সেটা তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।

একটি মৌলিক উদ্দেশ্য নিহিত ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবে, তা হলো জাতীয় ঐক্য গঠনের মধ্য দিয়ে একটি সুষম ও স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা

এসব বাদেও আরো একটি মৌলিক উদ্দেশ্য নিহিত ছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবে, তা হলো জাতীয় ঐক্য গঠনের মধ্য দিয়ে একটি সুষম ও স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে আসার পর তিনি যে সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন তার সফল বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের সিস্টেমে গিয়েছিলেন।

 

দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি

বহুমুখী কো-অপারেটিভ : বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কতগুলো কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ করার কর্মসূচি তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কো-অপারেটিভের ধরনটা ছিল এই রকম- প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। বেকার অথচ কর্মক্ষম মানুষ কো-অপারেটিভের সদস্য হবে। এই সদস্যদের কাছে সরকারি অনুদান যেমন নগদ টাকা, ফার্টিলাইজার, টেস্ট রিলিফ ইত্যাদি যাবে এবং এসবের সঠিক ব্যবহারের কর্মপন্থা পাঠানো হবে। উৎপাদিত পণ্য বা ফসল জমির মালিক ও কো-অপারেটিভের মধ্যে নির্দেশিত হারে বণ্টিত হবে।

থানা কাউন্সিল গঠন : প্রতিটি থানায় তিনি একটি করে থানা কাউন্সিল গঠন করতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক কর্মী বা সরকারি কর্মচারী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সহযোগী সদস্য হিসেবে থাকবেন বিভিন্ন সরকারি বিভাগের কর্মচারী এবং বাকশালের সদস্য, যুব প্রতিনিধি, কৃষক প্রতিনিধি। এদেরই সম্মিলিত প্রয়াসে থানা পরিচালিত হবে।

মহকুমা গঠন : জেলাকে তিনি মহকুমা জেলায় রূপান্তর করার কথা ঘোষণা করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে। সেখানেও সরকারি বা বেসরকারি একজন চেয়ারম্যান এবং সহযোগী সদস্য হিসেবে সরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে সরকারের অংশীদারিত্বমূলক একটা কাঠামো গঠনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।

 

পরিণতি

বঙ্গবন্ধু তাঁর এই দ্বিতীয় বিপ্লবের অসাধারণ যুগোপযোগী কর্মসূচি সফল করার সময় পেলেন না। তাঁর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেনি। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন আর সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তিনি সোনার বাংলা গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি জাতীয় বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাঙালি জাতিকে। বলেছিলেন তিনি- ‘আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বাঙালি জাতি যে প্রাণ, যে অনুপ্রেরণা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল যে প্রাণ, সেই অনুপ্রেরণার মতবাদ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে, দেশের দুঃখী মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।’ দেশের যুবসমাজের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার যুবক ভাইরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে এর ওপর বাংলার মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুল প্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পায়জামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর গ্রামে গ্রামে গিয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার জন্য কাজ করে যেতে হবে। যুবক চাই, ছাত্র চাই, সকলকে চাই।’

বঙ্গবন্ধু আশা করেছিলেন, ৭ মার্চের মতো তাঁর আহ্বানে আবারো বাংলার মানুষ তাঁর বটবৃক্ষের ছায়াতলে সমবেত হবে দলমত নির্বিশেষে। কিন্তু না, ততদিনে প্রতিবিপ্লবীরা তাদের হিংস্র নখরে বটবৃক্ষের মসৃণ ছায়াতল ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে। তবুও মানুষ তাঁর দিকেই অগ্রসর হতে প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু তারা তা হতে দিল না। তারা ভাবল আবার যদি একাত্তরের মতো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে আর সত্যিই বাংলার মাটিতে তাদের ঠাঁই হবে না। তারা জানত শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বাঙালি ফেলবে না। যতকিছুই হোক তারা আবার তাঁর কাছেই যাবে। কারণ, বাঙালির এত বড়ো দরদি আর ছিল না। অভিমান তাদের হয়েছিল বটে কিন্তু তবু তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে না গিয়ে থাকতে পারত না। তাঁর বিপ্লব সফল করতই। আর সে বিপ্লব সফল হলে বাংলাদেশ সত্যিকারের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতো, বাংলাদেশ হয়ে যেত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজকের বাংলাদেশকে যেখানে নিয়ে গেছেন সেটা স্বাধীনতার প্রথম দশকেই হওয়া সম্ভব ছিল এবং এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়- সেই বাংলাদেশ হতো আরো প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী স্বনির্ভর এক স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কাজেই তারা বটবৃক্ষ উপড়ে ফেলার মতো মহাপাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। যাদেরকে তিনি নিজের সন্তান বলে বিশ্বাস করতেন, তারাই পিতার বুক ঝাঁজরা করে দিল বুলেটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে শুধু নতুন বিপ্লব থেমে গিয়েছিল তা-ই নয়, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তাদের সামাজিক মুক্তির অগ্রযাত্রা এক তিমির বলয়ে বন্দি হয়ে গেল।

আরও পড়তে পারেন

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে নতুন করে আরও প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা…
জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

ঈদুল আজহার আগেই বাজারে ছাড়া হচ্ছে নতুন ডিজাইনের টাকার নোট, যা দুই টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত…
পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

সৌদি আরব হজ পারমিট সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যারা বৈধ…