বাংলাদেশের শিক্ষা : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

পৃথিবীর সব বিবেচনায় শিক্ষাই মানুষের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। মূল্যবোধ সৃষ্টিতে, মানসিক বিকাশে, সামাজিক উন্নয়নে, অবক্ষয় রোধে শিক্ষা যেভাবে সহায়কের ভূমিকা পালন করে আর কোনো শক্তি তা পারে না। তাই সামাজিক অগ্রগতির স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং বাস্তবতার আলোকে সব বিভ্রান্তি দূর করতে শিক্ষাই আমাদের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু একথাও ঠিক যে, শিক্ষার প্রকৃত রূপ ও স্বাদ অর্জন এবং প্রতিপালন করতে না পারলে জাতীয় জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। ব্যক্তি, সমাজ এবং বিশ্ব পরিসরও তখন অনিবার্যভাবেই অবক্ষয়ের মধ্যে নিপতিত হয়। বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরের শিক্ষা পরিস্থিতি বিবেচনার সময় আমাদের এই কথাগুলো বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। কেননা, স্বাধীন বাংলাদেশ নানান সূচকে অগ্রগতি লাভ করলেও মূল্যবোধের জায়গা থেকে এখনো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে; যোগাযোগ, মৎস্য, ডেইরি এবং কৃষিক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য লাভ করলেও মানসিক বিকাশে তেমনভাবে দৃষ্টি দিতে পারেনি এই রাষ্ট্র; বাণিজ্যিক বিস্তার অনেক করতে পারলেও আমরা সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই ‘অবক্ষয়’ নামের অসুখ বাঙালির নিত্যসঙ্গী হয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের চিন্তার এবং দুশ্চিন্তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যদিও এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে, শিক্ষা অনেকাংশেই মধ্যবিত্তের প্রধান অবলম্বন। উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত অথবা বিত্তহীন কখনোই শিক্ষাকে আশ্রয় ভেবে নিতে পারেনি। ধনী আর গরিবের কাছে টাকাটাই মুখ্য। তাই তারা তাদের সন্তানদের অর্থ-উপার্জনের দিকে বেশি মনোযোগী করে তোলেন। অন্যদিকে মধ্যবিত্তের সন্তানরাও ভালো (আকর্ষণীয় বেতনের) একটি চাকরির জন্য পড়ালেখার দিকে আকৃষ্ট হয়- বিশেষ করে পরিবারের আগ্রহে বা চাপে। ধনী ও ব্যবসায়ীরা সন্তানদের নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে হাঁফ ছাড়েন। অথবা চাকরির পেছনে ছোটার চেয়ে উদ্যোক্তা হয়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং বিশেষত মুনাফার জন্য যোগ্য হিসেবে তৈরি করতে ভালোবাসেন, এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্ররা পিছিয়ে। কেননা উদ্যোক্তা হয়ে বাণিজ্য কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠা ও তার সম্প্রসারণ তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত কঠিন পথ। তবে আশার কথা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর উচ্চবিত্ত এবং ব্যবসায়ীরাও পরবর্তী প্রজন্মকে উচ্চশিক্ষিত করতে অগ্রসর হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে তাদের সন্তানাদি নিজেদের ব্যবসার নেতৃত্ব দিচ্ছেন (যদিও অনেকের দ্বিতীয় প্রজন্ম ভিনদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ গ্রহণ করেছে)। মোট কথা, গত ৫০ বছরে এদেশে শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে- বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষার প্রয়োজনের ভুবন। প্রশাসনিক কাঠামো, শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রসারের ফলে চাকরির বাজার সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি লেখাপড়ার হার বেড়েছে। অবশ্য বিদ্যার নিম্নমুখী মান এবং চাকরির অপ্রতুলতার কথাও অস্বীকার করা চলে না।

শিক্ষানীতি অনুমোদনের ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে; যদিও এতে রয়েছে বেশকিছু অসংগতি ও অস্পষ্টতা। তবে শিক্ষা-প্রসারের পাশাপাশি এর বৈশিষ্ট্যগত রূপান্তরও বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। গ্রেডিং পদ্ধতি নিয়ে বিরূপ সমালোচনা থাকলেও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এবং অংশগ্রহণে এই পদ্ধতি নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করেছে

১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই একটি সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা সবার কাম্য ছিল। সাধারণ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা ইত্যাকার শিক্ষাপদ্ধতি একই প্রজাতন্ত্রে প্রচলিত থাকাটা শিক্ষার স্বার্থেই বিপজ্জনক। নিয়মিত ও স্বাভাবিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে সারা পৃথিবীতে আরো কয়েক ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি চালু রয়েছে- এগুলোর মধ্যে বয়স্কশিক্ষা, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, দূরশিক্ষণ, সাক্ষরতা অভিযান, সান্ধ্যকালীন শিক্ষা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়; বাংলাদেশে এ কয়টি শিক্ষাপদ্ধতি কোনো না কোনোভাবে প্রচলিত আছে।

বিগত ৫০ বছরে আমাদের শিক্ষাভুবনে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো শিক্ষানীতি প্রণয়ন। দেরিতে হলেও ২০১০ সালে এই যুগান্তকারী ঘটনার ভেতর দিয়ে জাতি একটি বিশেষ ও অনন্য জায়গায় উন্নীত হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। এর আগে কয়েকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও সেগুলো খসড়া পর্যায়ে আটকে ছিল। শিক্ষানীতি অনুমোদনের ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে; যদিও এতে রয়েছে বেশকিছু অসংগতি ও অস্পষ্টতা। তবে শিক্ষা-প্রসারের পাশাপাশি এর বৈশিষ্ট্যগত রূপান্তরও বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। গ্রেডিং পদ্ধতি নিয়ে বিরূপ সমালোচনা থাকলেও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এবং অংশগ্রহণে এই পদ্ধতি নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করেছে। আবার প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে কত দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হতে পারে, তা নিয়ে নাগরিক সমাজে রয়েছে নানা সংশয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের পেশাগত গ্রেড উন্নয়ন এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগের ফলে দীর্ঘদিনের সংকটের প্রায় অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে আধুনিক পাঠদান পদ্ধতির প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সহজতর হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে বিপুলভাবে বেড়েছে উত্তীর্ণের সংখ্যা। শত শত কলেজ প্রতিষ্ঠা ও সরকারি অনুদানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে খুলে গেছে নতুন নতুন দরোজা। প্রায় সব ইউনিয়নে কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে একথা ঠিক যে, প্রান্তিক পর্যায়ে অবকাঠামো ও শিক্ষক স্বল্পতাকে অগ্রাহ্য করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত হয়নি। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে গ্রামগঞ্জের ছেলেদের বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে স্কুল-কলেজে যেতে হতো। মেয়েরা সে সুযোগ পেত না। ফলে নারীশিক্ষার হার তখন ছিল খুবই কম। বিশেষ করে শহরে গিয়ে বা সেখানে অবস্থান করে লেখাপড়া করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষার সুযোগ অবারিত হয়েছে- এটি বড়ই আনন্দের কথা। ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা বা বিজয় অর্জন করেছি, তার ফল পেতে সহায়তা করেছে শিক্ষার বিস্তার। শিক্ষা মানুষকে স্বপ্ন দেখায়- জাতিকে কল্পনা ও পরিকল্পনার উন্নততর ধাপে পা রাখতে প্রেরণা জোগায়। স্বাধীন দেশে আমরা সে স্বপ্নে বারবার বিভোর হয়েছি। শিক্ষাকে আশ্রয় করে আমরা নতুন নতুন কল্পনার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করেছি।

বিগত তিন দশকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র। নব্বই দশকের শুরুতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি; পরবর্তীকালে নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা যেমন মানুষের বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে গেছে, তেমনি শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বাস্যরকমভাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে সীমিতসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী লেখাপড়ার সুযোগ পেত। বাকিদের কাছে উচ্চশিক্ষা ছিল অধরা বাসনামাত্র। বর্তমানে বেশি সংখ্যক প্রান্তিক শিক্ষার্থী সরকারি খরচে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে পারছে। অনেকে স্নাতক পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করে বিদেশের নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। এতে দেশের সুনাম বাড়ছে; রেমিট্যান্সেও প্রভাব ফেলছে এই প্রবণতা। একটা সময় ছিল যখন দেশের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাত। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যেত। ১৯৯২ সালে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে দেশে বসে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষালাভের সুযোগ পেল আমাদের ভবিষ্যৎ-নির্মাণকারী প্রজন্ম। দেশও আর্থিকভাবে লাভবান হলো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে শিক্ষা-বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির ফলে জেঁকে বসা বছরের পর বছর সেশনজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ  করেছে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ-প্রতিযোগিতার ইতিবাচক ফলাফলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সারাদেশে কলেজশিক্ষায় সম্প্রসারণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের  পড়াশোনা। ১৯৯২ সালের আগে অল্প কয়টি কলেজে গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ ছিল। বর্তমানে সে সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। যদিও দেশের সব প্রান্তরে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে কলেজের লেখাপড়ার মান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয় ও বিভ্রান্তি। শিক্ষক স্বল্পতা, গবেষক-শিক্ষকের অপ্রতুলতা, অবকাঠামোগত সংকট এবং বিশেষ করে আসনসংখ্যা বৃদ্ধির নামে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিকভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির ফলে কলেজশিক্ষার মান মারাত্মকভাবে নেমে গেছে বলে অনেকের ধারণা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে স্তরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জীবনে নতুন করে শিক্ষালাভের আনন্দধারা প্রবাহিত করেছে। এভাবে এদেশে উচ্চশিক্ষার উঠানে বয়ে গেছে প্লাবনের পানি। সবার অগোচরে বিপ্লব ঘটেছে জনজীবনে। সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিচিতি ও পরিসরের ব্যাপক রূপান্তর সাধিত হয়েছে এসব উদ্যোগের ফলে। যদিও উচ্চশিক্ষিতের ব্যাপক সংখ্যার নেতিবাচক দিককে স্বীকার করে, ভবিষ্যতে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে মনোযোগের দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে; অধীত জ্ঞান পেশাগত জীবনে যদি কাজে না লাগে, তাহলে অর্জিত শিক্ষা কারো জন্যই কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। এখন প্রয়োজন বৃত্তিমূলক ও মানসম্মত শিক্ষা; সংখ্যা বাড়ানোর প্রবণতা অনতিবিলম্বে পরিহার করে মান-উন্নয়নে ও কর্মমুখী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে সব মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।

সত্যিকার অর্থে শিক্ষার মুক্তি না হলে জাতির কাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথে কেন, দ্বারপ্রান্তেও আমরা পৌঁছতে পারব না। আর জাতিকে শিক্ষার আলো প্রদান করতে হলে ক্যাম্পাস থেকে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি অনতিবিলম্বে দূর করতে হবে। অবশ্য প্রয়োজনে নির্দলীয় শিক্ষক কল্যাণ পরিষদ এবং শিক্ষার্থী কল্যাণ পরিষদ থাকতে পারে; এই পরিষদগুলো কেবল নিজেদের অধিকার, মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে- সারা দুনিয়ার ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ রকম ব্যবস্থা রয়েছে

সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় কলেজশিক্ষার মান-উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বের অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ার বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ লাভ করছেন এদেশের কলেজশিক্ষকরা। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকলে এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নতুন নতুন চিন্তার প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হলে জাতির জন্য তা কল্যাণকর হতে পারে। মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করতে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা নিশ্চয়ই ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে একটি বড় অসংগতি রয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। আর তা হলো কলেজশিক্ষার বাস্তব অবস্থা মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও সংবিধিতে এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকলে অবহেলা বা উপেক্ষার কারণে মনিটরিং হচ্ছে না। এই সংকট অচিরেই কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।

দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলাদেশ চিন্তা ও গবেষণায় বিশ্ব দরবারে মর্যাদার সঙ্গে বিবেচ্য হয়ে উঠেছে। তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষির সম্প্রসারণে আমাদের শিক্ষাভুবন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ধান ও ফল গবেষণায় আমাদের সাফল্য দৃষ্টান্তমূলক। অর্থনৈতিক বিকাশে এভাবে শিক্ষা যে বিশেষ অবদান রাখতে পারে, তা বাংলাদেশে ৫০ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। তবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কর্মসূচি পরিচালনা করছে, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। গতানুগতিক বা প্রথাগত পাঠদানের সময় ফুরিয়েছে বেশ খানিকটা আগে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কোনোকালে ফ্যাশন হয়ে আবির্ভূত হয়নি। মানুষ এসবের প্রয়োগে নিজেদের ও অপরের জীবন-অভিজ্ঞান পাল্টে দিয়েছে। তাই সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের রূপ-রূপান্তর তার প্রতিটি পদক্ষেপ দিয়ে আমাদের সর্বদা সহায়তা করছে। প্রযুক্তি কোনো প্রতিকূল শক্তি নয়; আমাদের চলার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করাও এর কাজ নয়। প্রযুক্তি আমাদের বন্ধু। যেমন নিসর্গের শোভা। চাঁদের আলো। নদীর প্রবহমানতা। যেমন বাতাস ও সূর্যালোক। তাই শিক্ষাভুবনে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রজেক্টর, ডিজিটাল বোর্ড প্রভৃতির ব্যবহার আজ আর কোনো ফ্যাশনের পর্যায়ে পড়ে না- এটা প্রয়োজন। কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও অনলাইন বা ডিজিটাল ক্লাসসহ যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে শিক্ষাভুবনে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা।

আমরা জানি, জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ স্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষার এই পরিসরটিকে যত বেশি রাজনীতিমুক্ত ও দলাদলিমুক্ত রাখা যায়, জাতির জন্য ততই মঙ্গল। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বটেই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও দলীয় প্রভাবে স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত অ্যাকাডেমিক চরিত্র ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে শিক্ষার মুক্তি না হলে জাতির কাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথে কেন, দ্বারপ্রান্তেও আমরা পৌঁছতে পারব না। আর জাতিকে শিক্ষার আলো প্রদান করতে হলে ক্যাম্পাস থেকে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি অনতিবিলম্বে দূর করতে হবে। অবশ্য প্রয়োজনে নির্দলীয় শিক্ষক কল্যাণ পরিষদ এবং শিক্ষার্থী কল্যাণ পরিষদ থাকতে পারে; এই পরিষদগুলো কেবল নিজেদের অধিকার, মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে- সারা দুনিয়ার ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ রকম ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা (বিশেষত আমাদের কর্তাব্যক্তিরা) এত বিদেশ ভ্রমণ করি, তো সুপ্রতিষ্ঠিত ও সেরা সেরা সব বিদ্যাপীঠের কাঠামোগুলো দেখে তো কিছুটা ধারণা ও শিক্ষা নিতে পারি! জানি না, সে পরিবেশ ও সময় আমাদের বাড়ির উঠানে (জাতির ভাগ্যাকাশও বলা চলে) কবে হাজিরা দেবে!

বাংলাদেশ শিক্ষা কাঠামো, ব্যবস্থাপনা এবং মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে খুব বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে এমনটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি ও অসংগতি রয়ে গিয়েছে। শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছি আমরা। স্কুল পর্যায়ে ‘সহকারী শিক্ষক’ এবং কলেজ পর্যায়ে ‘সহকারী অধ্যাপক’ নামের শেকল ভাঙা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। এই প্রায় ‘চিরস্থায়ী’ পদের বন্ধন থেকে মুক্তি প্রয়োজন। আর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষাভুবনে সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এখনো তৈরি হয়নি। আবার সব স্তরে এবং সব প্রতিষ্ঠানে যে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাও নয়। কোনো কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেকার সৃষ্টির কারখানায় পরিণত হয়েছে; তারা সার্টিফিকেট বিতরণ করছে- জ্ঞান প্রদানের দিকে তেমনভাবে নজর দিচ্ছে না। পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার অভাবে প্রতি বছর শিক্ষা শেষ করে অনেকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না। মানবসম্পদ-ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু পরিবেশ আজও নিশ্চিত হয়নি। বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি না হওয়ায় একদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব, অন্যদিকে বাড়ছে দক্ষ-প্রশিক্ষিত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষিত লোকের অভাব। কাজেই এসব অসংগতি দূর করে চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে পেশা ও কর্মমুখী পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দিকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কিছু সাফল্য এবং অর্জনের পরও হিসাবের খাতা খুললে দেখা যায়, আমরা অনেক অনেক চিন্তার জায়গায় পিছিয়ে আছি। যেভাবে সাধারণ শিক্ষা বিস্তার লাভ করেছে, সেই তুলনায় কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার পথ বিস্তৃত হয়নি। সময়ের সঙ্গে, যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা শিক্ষাকে কাজে লাগাতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছি। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে শিক্ষাকে আমরা সম্পৃক্ত করতে পারিনি। এখন কৃষি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে কিংবা ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাস করে ব্যাংকে চাকরি করতে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া শেষ করে এখনো কাউকে কাউকে বেকার থাকতে হয়। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাকরি বাজারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে লাখ লাখ বেকারকে প্রতিদিন চাকরিতে আবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা না হলে শিক্ষার মানও ক্রমাগত নিম্নগামী হয়ে পড়বে। সম্ভবত পড়ছেও। কাজেই কোয়ান্টিটির সঙ্গে কোয়ালিটি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। তা না হলে ৫০ বছরে আমরা যতটুকু এগিয়েছি, হয়তো অনাগতকালে সে পথ থেকে ছিটকে পড়তে হবে। কিন্তু আমরা আশাবাদী। অর্জনকে ধরে রাখতে প্রত্যয়ী। শিক্ষাকে শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের মানুষ নির্মাণ করবে আগামীদিনের স্বপ্নময় রাজ্য। শিক্ষাই হোক এই প্রজন্মের প্রধান অস্ত্র।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক