রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং সুকান্ত নৈকট্য ও দূরত্ব

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং সুকান্ত নৈকট্য ও দূরত্ব

পাকিস্তান আমলে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্য এ তিনজনকে একসাথে স্মরণ করতাম। বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে একটা ধারা যা আমরা গ্রহণ করবো এমন পরিস্থিতি তখন ছিল। সেই ধারার সাথেই রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল তো অনেক বড় ব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ তো অসামান্য তাঁর সঙ্গে তো কারো তুলনাই চলে না, নজরুলও বড়। সুকান্ত তো মাত্র ২১ বছর বয়সে মারা গেলেন। ৭ বছর মাত্র সাহিত্য চর্চার করেছেন। তাঁকে আমরা স্মরণ করতাম এই জন্য যে আমরা মনে করতাম— যে স্বাধীনতা আমরা পেলাম সেই স্বাধীনতাকে আমরা আরো এগিয়ে নিয়ে যাবো। এবং বামপন্থী আন্দোলন তখন দেশে সক্রিয় ছিল। পশ্চিমবঙ্গেও সক্রিয় ছিল। সেটাকে ধারণ করে আমরা একসঙ্গে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী করতাম। এখন করি না।

তবে তাদেরকে যদি এক সঙ্গে স্মরণ করি তাহলে আমরা সাদৃশ্য দেখতে পাবো, পার্থক্যও দেখতে পাবো- তুলনার প্রশ্নই উঠে না। তুলনার ক্ষেত্রে তারা সবাই বিশিষ্ট। একজনের সাথে আরেকজন তুলনীয় নয়। আমরা এদের মধ্যে প্রথম যে জিনিস দেখতে পাবো সেটা হচ্ছে ‘জাতীয়তাবাদ’। রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেছেন। তিনি নিজেকে ভারতীয় বলতেন, কিন্তু তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে ভিত্তি সেটা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। এবং রবীন্দ্রনাথ যেটা করেছেন এই জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাও দিয়ে দিয়েছেন। যে সংজ্ঞাটা দাঁড় করিয়েছিলেন সেটা হচ্ছে ধর্মভিত্তিক। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— যে আমরা বাঙালী এই জন্য যে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। কিন্তু তাদের কাজের মধ্য দিয়ে; তাঁর কাজ, নজরুলের কাজ এবং সুকান্তর কাজের মধ্য দিয়ে সেই সংজ্ঞা অনেকটা প্রসারিত হয়েছে। কেবল বাংলা পড়লেই হবে না বাঙালীকে, বাংলাকে ভালোবাসতে হবে। এবং বাঙালীর মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে।

সুকান্ত একবারে পুরোপুরি বাঙালী। তাঁর কোনো লেখার মধ্যে আমরা ভারতের কথা দেখি না। তিনি বাংলার কথা বলেছেন, বাঙালীর কথা বলেছেন এবং বাংলায় যে বিদ্রোহ তার কথা বলেছেন। তিনি আবার একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক। নজরুলও আন্তর্জাতিক, সুকান্তও আন্তর্জাতিক। আমরা আরো একটা জিনিস দেখতে পাবো যে এই তিনজন কবি অন্য কবিদের থেকে আলাদা। তাঁরা কর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন। কবির যে ধারণা, যে তিনি সমাজ বিচ্ছিন্ন, শুধু কবিতাই লিখবেন— এই ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আরো ভেঙ্গে দিলেন নজরুল, সুকান্ত। তাঁরা কর্মী ছিলেন

এই যে সংজ্ঞাটা এটা আমরা তিনজনের কাছ থেকে পেলাম। রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর কবি, বাংলাভাষার কবি। নজরুল ইসলামের মধ্যে যেটা আমরা পেলাম সেটা হলো পরিপূর্ণ বাঙালী। এর আগে এমন বাঙালী দেখা যায়নি। বাঙালীর পরিচয়ের ক্ষেত্রে দুটো অসুবিধা ছিল বলে আমরা জানি। একটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা আরেকটা হচ্ছে শ্রেণী বিভাজন। নজরুল এ দুটোকেই ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি তো সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। এবং তিনি সম্পূর্ণ শ্রেণী বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়েছেন। কাজেই সম্প্রদায় এবং শ্রেণীর যে বিভাজন সে দুটোই নজরুল ভেঙ্গে দিতে চেয়েছেন তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। এবং গোটা বাঙালীর যদি প্রতিনিধিত্ব কেউ করেন, কোনো কবি করেন, বাংলাভাষী মানুষের প্রতিনিধিত্ব কেউ করে থাকেন তবে তা নজরুল করেছেন। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে যে হিন্দু পুরাণ এবং মুসলমানদের যে কাহিনি সেগুলোকে একসাথে করে দিয়েছেন। এই কাজ তাঁর আগে কেউ করতে পারেনি। তিনি একেবারেই খাঁটি বাঙালী এবং তিনি পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন না। তিনি তাঁর বন্ধুরা, মুসলমান বন্ধুরা যখন পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে গেছেন তখন নজরুল পাকিস্তানকে ফাঁকিস্থান বলেছিলেন। তিনি শেষে একেবারে যখন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছেন তারও আগে বাঙালীর জয়ের কথা বলেছেন এবং এই বাঙালীর যে জয় হবে সেখানে ব্রিটিশের স্থান থাকবেই না। তারা চলেই যাবে সেখানে ‘রামা আর গামাদেরও’ জায়গা হবে না। রামা বলতে তিনি হয়তো মাড়োয়ারীদের বুঝিয়েছেন, গামা বলতে হয়তো পাঞ্জাবী মুসলমানদের বুঝিয়েছেন। রামা-গামা কেউ থাকবে না— এই কথাটা তিনি বলেছেন। তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদকে আরো শক্তিশালী করলেন, শাণিত করলেন এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

সুকান্ত একবারে পুরোপুরি বাঙালী। তাঁর কোনো লেখার মধ্যে আমরা ভারতের কথা দেখি না। তিনি বাংলার কথা বলেছেন, বাঙালীর কথা বলেছেন এবং বাংলায় যে বিদ্রোহ তার কথা বলেছেন। তিনি আবার একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক। নজরুলও আন্তর্জাতিক, সুকান্তও আন্তর্জাতিক। আমরা আরো একটা জিনিস দেখতে পাবো যে এই তিনজন কবি অন্য কবিদের থেকে আলাদা। তাঁরা কর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন। কবির যে ধারণা, যে তিনি সমাজ বিচ্ছিন্ন, শুধু কবিতাই লিখবেন— এই ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আরো ভেঙ্গে দিলেন নজরুল, সুকান্ত। তাঁরা কর্মী ছিলেন। তাঁরা কাব্যের চর্চা করেছেন, রাজনীতি করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, আন্দোলন করেছেন এবং বক্তৃতা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ তো একটা বিশ্ববিদ্যালয়। নজরুল গানে গানে একেবারে যৌবনে চলে গেছেন। সুকান্ত সবসময়ই বিপ্লবী বাংলার কথা বলেছেন। সুকান্তর জন্য এটা আরো সত্য যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি তাঁর সেজো বৌদির কাছে চিঠিতে লিখেছেন যে, ‘আমার কবি পরিচয়ের চাইতেও বড় পরিচয় যে আমি কমিউনিস্ট। আমাকে তো জনতার সঙ্গে থাকতে হবে।’ এবং তিনি সেই সময় যে কিশোর বাহিনী গঠিত হয়েছিল তার প্রধান সংগঠক ছিলেন। কাজেই আমরা দেখছি যে, কবির যে ধারণা সেই ধারণা আলাদা। যেমন ত্রিশের কবিদের মধ্যে আপনি পাবেন না যিনি রাজনৈতিক বা সামাজিক কাজ করেছেন। হয়তো পেশাগত কাজ করেছেন তারা। এই তিনজন কবি সেটা করেছেন এবং আমরা যদি দেখি যে ঐ পাঁচজন যে কবি তাঁরা আলাদা, তাঁরা অন্য রকমের। আমরা যদি জীবনানন্দ দাশের কথা বলি তিনি খাঁটি বাঙালী কোনো সন্দেহ নেই। তিনি অত্যন্ত বড় মাপের কবি সেটা আমরা জানি। কিন্তু তিনি কর্মজগতের বাইরে। অন্য কোথাও যাচ্ছেন না— শুধু কবিতার ক্ষেত্রেই থাকছেন। আর একটা বিষয়, এই যে তিনজন কবির কথা আমরা আলোচনা করছি তাঁরা প্রচণ্ড রকম আশাবাদী ছিলেন। এই আশা তাঁরা কখনো পরিত্যাগ করেননি। এই আশা আমরা অন্যদের মধ্যে দেখি না।

পার্থক্যে যাওয়ার আগে আমি একটি জিনিস বলতে চাই এই তিনজনের যে সংগ্রাম, যে বৈরিতা, যে শত্রæতা ছিল তা হলো পুঁজিবাদ। রবীন্দ্রনাথ পুঁজিবাদ কথাটা ব্যবহার করেননি, নজরুল করেছেন, সুকান্ত তো আগাগোড়াই পুঁজিবাদ বিরোধী।

রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯১৭ সালে ন্যাশনালিজম বক্তৃতা দিচ্ছেন জাপানে ও আমেরিকায় গিয়ে সেখানে তিনি ন্যাশানালিজমের বিরুদ্ধে বলছেন। এই ন্যাশনালিজম হচ্ছে পুঁজিবাদ, সাম্রজ্যবাদী ন্যাশনালিজম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উদারনৈতিক, উদারনীতির যতদূর যাওয়া যায় তিনি ততদূর গেছেন। সেই জন্য তিনি পুঁজিবাদ কথাটা ব্যবহার করেননি, সাম্রাজ্যবাদ কথাটা ব্যবহার করেননি। কিন্তু যার বিরুদ্ধে তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সেই খোদ আমেরিকায় গিয়ে, জাপানে গিয়ে সেটা ছিল পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ১৯১৭ সাল, যুদ্ধ চলছে সেই সময়টা। এবং আমরা তারপর দেখতে পাবো ‘রক্তকরবী’ নাটক। ১৯২৬ সালে তিনি এটা লিখলেন সম্পূর্ণ পুঁজিবাদকে উন্মোচিত করে। পুঁজিবাদ কী করে কৃষিকে ধ্বংস করেছে, কৃষি ধ্বংস করে অকর্ষণজীবীকে নিয়ে আসছে, খনিকে নিয়ে আসছে, মানুষকে ধ্বংস করেছে, উৎপাটিত করছে তার বিরুদ্ধে লিখছেন কিন্তু পুঁজিবাদ কথাটা ব্যবহার করছেন না। এবং সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তন হচ্ছে। রাজা বেরিয়ে যাচ্ছেন, বেরিয়ে কৃষিতে যাচ্ছেন, ফসলের মাঠে যাচ্ছেন এটি নতুন। এইখানে যে উদারনীতির সীমা সেটাই আমরা দেখবো। আমরা এটাও দেখতে পাই যে রবীন্দ্রনাথ যখন রাশিয়াতে গেলেন, রাশিয়া দেখে তিনি অভিভ‚ত হয়ে পড়লেন। তীর্থ দর্শন সম্পূর্ণ হলো বলে তিনি বললেন কিন্তু তিনি বলশেভিকের পক্ষে বলতে পারলেন না। বলশেভিকের মধ্যে তিনি বল প্রয়োগ দেখেছেন এবং পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে বলশেভিকের তন্ত্র আর জারতন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। এটা একই গোত্রের পাশ ফেরা। এটাই হচ্ছে উদারনীতির সীমা। তিনি সামাজিক বিপ্লব চাচ্ছেন, এই রুশ দেশের উন্নতি চাচ্ছেন কিন্তু সেটা সম্ভব হবে কীভাবে? সম্ভব হবে শিক্ষার মধ্য দিয়ে, সম্ভব হবে সমবায়ের মাধ্যমে কিন্তু সেটা যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে হবে এটা তিনি মানতে পারছেন না। এটাও হলো উদারনীতির সীমা। আবার আমরা দেখি ওখান থেকে ফিরে এসে তিনি যে ‘কালের যাত্রা’ লিখলেন। এটা ‘রথের রশি’ বলে পরিচিত যাত্রা নাটক যেখানে তিনি দেখাচ্ছেন ইতিহাসের যে রথ সেটা স্তব্ধ হয়ে গেছে, মহামারি দেখা দিচ্ছে। তার মধ্যে খরা দেখা দিচ্ছে, বিষম বিপদ। ইতিহাস চলছে না। রথ আটকে গেছে। তখন রাজারা পারেনি, সৈনিকরা পারেনি, বালকরা পারেনি, পন্ডিতরা পারেননি। এরূপ সময়ে শূদ্ররা এল। শূদ্ররা এসে যখন রশি ধরে টান দিল তখন রথ চলতে আরম্ভ করলো। তবে রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে দিচ্ছেন শূদ্ররাও যদি একপেশে হয়ে যায় তবে এই রথ আবার স্তব্ধ হয়ে যাবে। এটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের অবস্থা যে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বলছেন কিন্তু উদারনীতির জায়গা থেকে তিনি এই লড়াইটা চাচ্ছেন।

নজরুল যে কাজটা করলেন— তিনি গণসংগীত নিয়ে এসেছেন এবং গণসংগীতের ধারণায় নিয়ে এসেছেন ‘কোরাস’ অর্থাৎ একসাথে গেয়ে উঠবে। যেমন— ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ এই গান একসাথে গাইবে সব মানুষ। রবীন্দ্রনাথের ‘ঐক্যতান’ কবিতা এবং তার ‘ওরা কাজ করে’ কবিতায় তিনি শ্রমিকের কথা বলেছেন, কৃষকের কথা বলেছেন যে, সভ্যতা ওদের কারণেই বেঁচে আছে। ‘ঐক্যতান’ কবিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ কবিতা

নজরুল ইসলামকে আমরা দেখবো তিনি তো সম্পূর্ণ অন্য জায়গা থেকে এসেছেন এবং একদম আলাদা জায়গায় চলে গেছেন। .. .. … নজরুল যখন ‘গণবাণী’তে এলেন তখন কিন্তু আর রবীন্দ্রনাথের কাছে আশির্বাদ নিতে আসেননি। কারণ গণবাণী আলাদা। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই নতুন যুগের মুখপাত্রকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন। অন্য কেউ নজরুলকে বড় কবি হিসেবে স্বীকার করত না। এবং ঐ যে ঘটনা তিনি তাঁর … বই গীতিনাট্য ‘বসন্ত’ উৎসর্গ করলেন নজরুলকে। চব্বিশ বছরের এ যুবককে রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম তাঁর আপনজনদের বাইরে একটি কবিতার বই উৎসর্গ করলেন এবং নিচে লিখেছেন কবি। কবি হিসেবে নজরুলকে পুনরায় স্বীকৃতি দিলেন। রবীন্দ্রনাথের চারপাশে যারা ছিলেন তারা স্বীকৃতি দিচ্ছিলো না। তারা কেউ কেউ বলেছিল ইনি তো (নজরুল) সাংবাদিকতা করে, এত সমসাময়িক …। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে কবিতাতে কালের মন ধরা পড়ে যে কবিতা শুধু কবিতা নয়, সে মার্কস…। এই যে নজরুলকে চিনতে পারা, এই চিনতে পারাটা রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই ছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তাদের বিরোধ ছিল।

আমরা কয়েকটা পার্থক্যের কথা বলি, যেমন ধরুন শিশু কবিতা। রবীন্দ্রনাথতো শিশু কবিতা নিয়ে অনেক লিখেছিলেন। আমরা দেখতে পাই যে ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় একটি শিশু তার মায়ের সাথে পালকীতে যাচ্ছে, তখন দস্যু এল। শিশু দস্যুদের মেরে ফেলল। তখন মা বললেন, ভাগ্যিস খোকা সঙ্গে ছিল। এই শিশু মাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু নজরুলের শিশু আরেক রকম। যেমন ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি’। এখানে মা বলেছেন- ‘হয়নি সকাল ঘুমাও এখন’। শিশু বলছে, ‘হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে নাকো?’ আবার বলছে, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ এই যে প্রশ্ন, এই যে কথাটা, এর মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে একটা নতুন শিশু আসছে এবং এই শিশু আগের শিশুর মতো নয়।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ আর নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ এই দুটোতে … … এবং সেইখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। বলছেন ‘ভাঙ্গিব পাষাণ কারা, …ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা।’ আবার বলছেন ‘আমি ঢালিব করুণাধারা। আমি সারা পৃথিবী.. করবো। গান গাহিবো’— এটাই রবীন্দ্রনাথ। নজরুলের কথাটা হলো— আমি বিদ্রোহী। তিনি বিদ্রোহের কথা বলেছেন। বলেছেন খোদার আরশ ভেদিয়া উঠিয়াছি আমি বিস্ময়। সারা বিশ্বের বিস্ময় আমি- এই যে দুটো পার্থক্য আমরা দেখি অথচ কাছাকাছি জায়গা থেকে লিখছেন, রবীন্দ্রনাথ কলেজ স্ট্রিট নিউমার্কেট আর নজরুল ওর কাছেই ভাড়া করা মেসে থাকেন।

আমরা আবার দেখবো ‘দুই বিঘা জমি’তে উপেনকে জমিদার উচ্ছেদ করে দিয়েছে সে ভবঘুরে হয়ে আবার ফেরত এসেছে এবং সে বলছে ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে’। কিন্তু যখন নজরুল লিখেছেন তখন নজরুলের কবিতা হলো ‘কুলি-মজুর’। উপেন তখন কুলি মজুর হয়ে গেছে। তারা নির্যাতিত হচ্ছে, যেমন নজরুল ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় বলেছেন- ‘এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ তিনি আরো বলেছেন- ‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।’ ঋণ করেছো তুমি, ধনী হচ্ছে মহাজন, ধনী হচ্ছে জমিদার। উপেনের মিথ্যা ঋণ ছিল জমিদারের কাছে। নজরুল বলছেন ধনী হচ্ছে মহাজন— তুমি মহাজন, তুমিই ধনী … । সেটা শুধু এক জায়গায় নয়, জগৎ জুড়ে বিপ্লব হবে। এই পার্থক্য আমরা দেখতে পাচ্ছি। নজরুল ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় বলেছেন, ‘আজ নিখিলের বেদনা আর্ত পীড়িতের মাখি খুন, লালে লাল হয়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!’ তো এই যে নজরুল ‘খুন’ শব্দটা বলছেন এটা নিয়ে অনেক মামলা হয়েছে আপনারা জানেন। এমন কি … এই খুন শব্দটা পছন্দ করেননি। খুন শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ কী করে ব্যবহার হবে তা তারা ভাবেননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও অপছন্দ করেছেন। কিন্তু নজরুল খুন নিয়ে এসেছেন, রক্ত নিয়ে এসেছেন, সবই নিয়ে এসেছেন। এবং এই কথাটা বলছেন যে কুলি মজুর নয় তিনি … ঐ খুনির মধ্যেও বিপ্লবের কথা আছে। পিতৃতান্ত্রিকতা আমাদের সমাজে পুরানো ব্যবস্থা। পিতৃতান্ত্রিকতা আমাদের সমাজে এখনও আছে। কিন্তু নজরুল এই পুরো পিতৃতান্ত্রিকতা কেটে দিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন—

‘সাম্যের গান গাই

আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।’

আবার বলছেন,

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।

আবার বলছেন,

সে যুগ হয়েছে বাসি,

যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক,

নারীরা আছিল দাসী

সে যুগ হয়েছে বাসি।

বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ

আজি,

কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও,

উঠিছে ডঙ্কা বাজি।— এই ডঙ্কা বাজি এটা নজরুল নতুন নিয়ে এসেছেন।

নজরুল বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য।’ এখানে বলেছেন ডঙ্কা বাজাচ্ছে। এখানে বলেছেন অভিনবতাকে অভিনন্দন জানাতে। নজরুল বলেছেন আমি নতুন যুগের মুখপাত্র, নতুন যুগের ত‚র্যবাদক, অগ্র সৈনিকের ত‚র্যবাদক। এই যে ত‚র্যবাদক এই যে ডঙ্কা নিয়ে এসেছেন এটা সম্পূর্ণ নতুন জিনিস। এই জায়গায় নজরুল আলাদা হয়ে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের থেকে। আমরা দেখতে পাচ্ছি নজরুল রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা একটা ধারা তৈরি করেছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের অগ্রগতিটা একটু সংক্ষেপে দেখে নিই। ১৮৯৩ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘এবার ফেরাও মোরে’। এখানে তিনি বলেছেন এতোদিন আমি রাখালের মতো একলা বাঁশি বাজিয়েছি। এখন দেখি আগুন লেগেছে … গ্রামে। সেখানে তিনি বলেছেন ‘এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা… যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে…’ এই কথাটা বলে রবীন্দ্রনাথ চলে এসেছেন গণমানুষের কাছে। এবং ১৯৩১ সালে তিনি ‘প্রশ্ন’ কবিতায় লেখেন— ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে’। তারা ক্ষমা করলো কিন্তু আমি তো অন্য জিনিস চেয়েছি। ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ আবার আর এক লাইন— ‘আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিস্ফল মাথা কুটে’। এই সমস্ত মানুষের বেদনা তিনি নিয়ে এসেছেন, এই বেকার যুবকের কষ্ট। তারপরে তিনি ১৯৪১ এ ‘ঐক্যতান’ কবিতায় লিখেছেন এটা খুব কৌত‚হল উদ্দীপক যে বাংলা গানে মেলোডি আছে, একটানা সুর আছে। এখানে রবীন্দ্রনাথ হারমনি, ঐক্যতান নিয়ে এসেছেন। অনেক সুরকে একসাথে মিলাতে চেয়েছেন। নাম দিলেন ‘ঐক্যতান’।

নজরুল যে কাজটা করলেন— তিনি গণসংগীত নিয়ে এসেছেন এবং গণসংগীতের ধারণায় নিয়ে এসেছেন ‘কোরাস’ অর্থাৎ একসাথে গেয়ে উঠবে। যেমন— ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ এই গান একসাথে গাইবে সব মানুষ। রবীন্দ্রনাথের ‘ঐক্যতান’ কবিতা এবং তার ‘ওরা কাজ করে’ কবিতায় তিনি শ্রমিকের কথা বলেছেন, কৃষকের কথা বলেছেন যে, সভ্যতা ওদের কারণেই বেঁচে আছে। ‘ঐক্যতান’ কবিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। এটা অস্বীকৃতির কবিতা যেখানে তিনি বলেছেন— ‘আমি তো বিশ্বের অনেক জায়গায় গেলাম কিন্তু আমার কবিতা সর্বত্রগামী হতে পারলো না। কৃষাণের জীবনে আমি পৌঁছাতে পারি নাই। কৃষকের জীবনে শরীক যে জন কর্মে ও কথায় সত্য পরিচয়। … হয়েছে অর্জন।’

‘যে আছে মাটির কাছাকাছি, যে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি’— এই যে প্রতীক্ষা করছেন, তিনি নিজে বলেছেন এটা আমি নিজে দিতে পারিনি। এজন্য আমার প্রতীক্ষা। তবে কি আমরা বলবো এই প্রতিক্ষীত কবি হচ্ছেন নজরুল ইসলাম? কিছুটা, পরিপূর্ণ অর্থে বলতে পারছি না। কেননা নজরুল ঐখানে রইলেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত একাকী নির্বাসনে চলে গেলেন। অথবা চলে যেতে বাধ্য হলেন। সুকান্ত আরো এগিয়ে নিয়ে গেছেন যা রবীন্দ্রনাথ চাচ্ছেন। কিন্তু তিনি তো অল্প বয়সে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হলেন। এখানে আমরা আর একটা জিনিস দেখি, নজরুল ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে আনসারের কথা বলেছেন। আনসার বলশেভিক দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছে। আগে জাতীয়তাবাদী ছিল, পরে বলশেভিক হয়েছে। কিন্তু আনসারের যক্ষ্মা হয়েছে, ক্ষয় রোগ হয়েছে। আনসার মারা গেল এই আন্দোলনের মধ্যে..।

রবীন্দ্রনাথ যখন মারা গেলেন তখন নজরুলের মধ্যে দুর্বলতাগুলো দেখা দিচ্ছে। এরপরতো তিনি থেমেই গেলেন। তখন তিনি তিনটা কবিতা লিখলেন— ‘দুপুরের রবি ঢলে পড়েছে অস্তাচলের কোলে।’ আর এক জায়গায় লিখেছেন— ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এর একটি কবিতা তিনি রেডিওতে পড়তে যেয়ে তাঁর জিহ্বা আড়ষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলো। এত তাঁর শোক ছিল।

এখন আমরা দেখবো সুকান্ত কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখছেন। এই দেখার মধ্যে আমরা সুকান্তর বৈশিষ্ট্যগুলো পেয়ে যাব। রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সালে মারা গেলেন। তার কিছু পরেই সুকান্তর মৃত্যু হলো। ২৫শে বৈশাখের উদ্দেশ্যে সুকান্ত যে কবিতা লিখেছেন তাতে তিনি বলেছেন, হতাশার স্তব্ধবাক্য সব এখন, ভাষা আমাদের নেই তাই ২৫শে বৈশাখ নতুন রূপে তুমি আর একজন রবীন্দ্রনাথকে পাঠাও। নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্র ঠাকুর। বিপ্লবীর স্বপ্ন চোখে-কণ্ঠে গণসংগীতের সুর। ঐ যে বিপ্লবের সুর যেটা নজরুল দেখছেন, গণসংগীত যা নজরুল এনেছেন সেটাই সুকান্ত নতুন রবীন্দ্রনাথের কাছে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন, কণ্ঠে গণসংগীতের সুর থাকবে। আবার রবীন্দ্রনাথের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি (সুকান্ত) বলেছেন, ‘.. এখন আতংক দেখি

পৃথিবীর অস্থিতে মজ্জায় সভ্যতা কাঁপিছে লজ্জায়।’ তো এই যে তাঁর মধ্যে আশা আছে। এ রকম জীবনানন্দ দাশও লিখেছেন। কিন্তু পার্থক্য এই যে সুকান্ত এটাকে এগিয়ে নিয়ে বিশুদ্ধ হচ্ছেন কিন্তু হতাশ হচ্ছেন না। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি আর একটা কবিতায় লিখেছেন— ‘এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি, নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি।’ আবার বলেছেন আমি দুর্ভিক্ষের কবি। এই যে পার্থক্য আপনার সাথে আমার।

‘আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি

প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।’

তাই  আজ আমাদের বিশ্বাস শান্তির ললিত বাণী শোনাতে ব্যস্ত … প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে। .. সংগ্রামের তরে।

আমরা জানি সুকান্ত বলেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি।’ তিনি নতুন উপলব্ধির মধ্যে চলে এসেছেন। এই যে দুর্ভিক্ষের ছবি জয়নুল আবেদীনের মধ্যে দেখি সে ছবি আপনারা সুকান্তর কবিতার মধ্যেও পাবেন। মধ্যবিত্ত কীভাবে এই দুর্ভিক্ষকে দেখছেন.. ..। সুকান্ত যে বাংলাকে দেখতে পাচ্ছেন— ঐ যে শিশু তার প্রথম কবিতা ‘ছাড়পত্রে’ বলেছেন,

‘চলে যাবো— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি’— সেই অঙ্গীকার করেছেন। তারপর বলেছেন,

‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ

কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে’

আবার,

‘সাবাস, বাংলাদেশ,

এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ

জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

এবার ‘লেনিন’ এর কথা বলতে হবে। লেনিনকে এর আগে কেউ এভাবে কবিতায় ব্যবহার করেননি। আপনার জানেন তিনি লিখেছেন,

‘ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, চীন

যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।

তারপর

লেনিন ভূমিষ্ঠ রক্তে

ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ

বিপ্লব স্পন্দিত হৃদয়ে মনে হয় আমিই লেনিন।’

তো এই যে আশার কথা বলছেন তখন তিনি অত্যন্ত কাতর অবস্থায় আছেন মৃত্যুশয্যায়।

উপসংহার

এই যে তিনজন কবি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অগ্রগতি সেই ধারাবাহিকতাটা কেন রক্ষিত হলো না? এটা একটা প্রশ্ন। আর একটা প্রশ্ন হলো— নজরুল এবং সুকান্ত। নজরুল যে ধারাটা তৈরি করলেন সেই ধারার সাথে কিন্তু সুকান্ত যুক্ত হতে পারলেন না। এই যে সংযুক্তির অভাব এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ আমার কাছে। সুকান্ত রবীন্দ্রনাথের কথা কতবার বলেছেন। কিন্তু নজরুলের কথা একবারও বলেননি। তার মানে ঐ যে আন্দোলনটা তৈরি হয়েছিল সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। এবং নজরুল যে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তার অনেক কারণ আছে। একটা কারণ যে আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত হলেন সেটা এগোল না। সেটা সা¤প্রদায়িকতা দিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেল কিছুটা। কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তারপর ঢাকার সোমেন চন্দ্র আর কলকাতার আমাদের সুকান্ত তারা একই বয়সের কিন্তু তবু তারা একত্র হতে পারছেন না। যেমন সোমেন চন্দ্র নিহত হলেন কাদের হাতে? আরএসপি’র হাতে, যারা নিজেদেরকে সোশালিস্ট মনে করতেন। তাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি কুৎসা রটনা করেছেন, সুভাষ বসুকে কুৎসিতভাবে চিত্রিত করেছেন, জাপানের দালাল বলেছেন। এই যে বিভক্তি এই যে বিভ্রান্তি আন্দোলনে সেটা ছিল। আর এই যে কমিউনিস্ট পার্টি তা বিপ্লবী পার্টি হিসেবে থাকলো না। সেই পার্টি নির্বাচনের পার্টিতে পরিণত হলো। এই সমস্ত কারণগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখার মতো। আর সবচেয়ে বড় যে ঘটনা ১৯৪৭ সালের দেশভাগ সেটা আলাদা করে দিলো … যে একসাথে কাজ করার জায়গাটা রইলো না।

শেষ কথা হলো এই যে কবিদের আমরা একসময় বীর হিসেবে দেখতাম তাঁদের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতাম একসাথে। তাঁদের কাছে কিসের জন্য যেতাম? যে বীরের অভাব ছিল আমাদের সময়, বীরের অভাব এখনো রয়েছে। কিন্তু সাহিত্য ঐ জায়গাটা পূরণ করতে পারছে না। শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বে এখন সাহিত্যের গভীর একটা বিপদ চলছে। নোবেল পুরস্কারের মতো পুরস্কার দেওয়ার মতো লোক পাওয়া গেল না। ডিলেন তিনি গান লেখেন, তিনি সংগীতজ্ঞ। তিনি নিতেও চাচ্ছিলেন না তাঁকেই নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো। আবার এক বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেয়াই হলো না কারণ যারা ছিলেন তাদের মধ্যে গোলযোগ দেখা গেল। আমাদের বাংলাদেশে স্বাধীনতা পুরস্কার (সাহিত্যের জন্য) নিয়ে কী ঘটনা হয়েছে তা আপনারা দেখেছেন। একবার যাকে দেওয়া হলো তাকে কেউ চেনে না। তারপর সেটা প্রত্যাহার করা হলো। সম্প্রতি যাকে দেওয়া হলো তিনি এক অদ্ভুত লোক। তিনি নাকি খুনের মামলার আসামীও ছিলেন। মরোণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হলো সেটা নিয়ে তদন্ত চলছে। মূল কথা হচ্ছে সাহিত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সাহিত্যের শত্রুটা কে? সাহিত্যের শত্রু হচ্ছে ঐ পুঁজিবাদ। যার বিরুদ্ধে আমাদের এই তিন কবি লড়েছেন। পুঁজিবাদ বিনোদনে বিশ্বাস করে, মুনাফাতে বিশ্বাস করে। পুঁজিবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে।

সাহিত্য মানুষকে মুক্ত করে সংযুক্ত করে। সেই যে সংযোজন সেই সংযোজনের বিরুদ্ধে এই পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ নিকৃষ্টতম ঐ জায়গায় গেছে, যেয়ে সেখানে ফ্যাসিবাদী আকার ধারণ করেছে। এভাবেই সাহিত্যকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। কিন্তু সাহিত্যের কাছেই আমাদের যেতে হবে। সাহিত্য বাদ দিয়ে আমরা পারবো না। আমরা যে সংবেদনশীলতা, যে সংলগ্নতা চাই তা সাহিত্যই দেবে। কোন সাহিত্য? এ সেই সাহিত্য যার মধ্যে গভীরতা আছে। যা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্তের মধ্যে ছিল। যেটা আজকের সাহিত্য রচনার মধ্যে আমরা পাচ্ছি না। সাহিত্যে সংবেদনশীলতা ছিল এবং যেখানে আর একটা জিনিস ছিল— জ্ঞান। জ্ঞান কেবল বই থেকে আসেনি, জ্ঞান আন্দোলন থেকে এসেছে। যে জ্ঞান জনজীবনে অংশগ্রহণ থেকে এসেছে। তো ঐ জায়গাটিতে আমাদের নিয়ে যেতে হবে সাহিত্যকে। যেখানে না নিয়ে যেতে পারলে সাহিত্য মূল্যায়ন করতে পারব না এবং আমাদের যে মুক্তি সে মুক্তি আমরা পাবো না। আর সামনেও আগাতে পারব না। আমাদের লড়াই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। আর এই তিন কবিকে আমরা দেখবো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

এই তিন কবির উত্তরাধিকার আমরা পেয়েছি— এটা আমাদের বড় সম্পদ। এটাকে সম্প্রসারিত করা আমাদের দায়িত্ব।

আরও পড়তে পারেন

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে নতুন করে আরও প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা…
জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

ঈদুল আজহার আগেই বাজারে ছাড়া হচ্ছে নতুন ডিজাইনের টাকার নোট, যা দুই টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত…
পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

সৌদি আরব হজ পারমিট সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যারা বৈধ…