
রাজনীতি ও পাঠাগার
- নিবন্ধ
- মার্চ ২৭, ২০২৪
পাঠাগার হলো সুবিন্যস্ত তথ্যভান্ডার— সংগ্রহশালা কিংবা আর্কাইভস। অন্যভাবে পাঠাগারকে বলা যেতে পারে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কালচারাল সেন্টার। পাঠাগারের সার্বিক প্রতিবেশ ব্যক্তির চিন্তা ও কল্পনার স্তরকে উন্নত করে। জীবনের পথ চলতে ও চালাতে পাঠাগার যেভাবে ভূমিকা পালন করে, আর কোনো প্রতিষ্ঠান তেমনটা করতে পারে বলে মনে হয় না। পৃথিবীখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেন বলেছেন — ‘যাঁর বাড়িতে একটি লাইব্রেরি আছে, মানসিক ঐশ্বর্যের দিক থেকে সে অনেক বড়’। সত্যিকার অর্থেই লাইব্রেরি হলো জ্ঞানের ভান্ডার। আর জ্ঞান ক্ষমতায় আরোহনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সিঁড়ি। সমাজ এবং সংস্কৃতি একসময় ছিল জীবন-যাপনের প্রধান আশ্রয়। গ্রামের আটচালা ঘর, গৃহস্থ বাড়ির বৈঠকখানা, বটতলা কিংবা হাট-বাজার ছিল প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আশ্রয় ও আশ্রম।
কিন্তু সভ্যতার বিবর্তনে সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে জায়গা করে নিয়েছে রাজনীতি। ক্রমে ক্রমে রাজনীতি হয়ে উঠেছে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। খাদ্য-নিরাপত্তা থেকে শুরু করে বস্ত্র-বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি প্রাথমিক মৌলিক অধিকারগুলো সমাজ-কাঠামোর আওতা থেকে রাজনীতির ছায়াতলে জায়গা করে নিয়েছে। মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির ভূমিকা বর্তমানে সবচেয়ে প্রবল। আর তাই, রাজনীতির কারবার এখন জ্ঞানীদের বিচরণভূমি। কাজেই রাজনীতির কর্মী ও নেতাকে, জ্ঞানে ও বোধে, অন্যান্য নাগরিকের তুলনায় এগিয়ে থাকতে হয়। রাজনীতির লোকেরা সাধারণ হয়েও অসাধারণ। রাজনীতির মাঠ এমন এক জায়গা, যেখানে মানুষকে সর্বোতভাবে নিবেদিত হতে হয়। এখানে গ্রহণের আশার চেয়ে প্রদান আর ত্যাগের প্রত্যয় বেশি থাকা প্রয়োজন। গ্রহণের প্রত্যাশা ছেড়ে প্রদানের প্রতিশ্রুতি ধারণ করে রাজনীতিতে প্রবেশ ও বিচরণ করার দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। রাজনীতি তো মানুষের কল্যাণের জন্য; তাই ত্যাগই এখানে প্রধান। তাহলে, প্রশ্ন হতে পারে, মানবজীবনে গ্রহণের জায়গা কোনটি? হ্যাঁ, গ্রহণের জায়গা হলো পাঠাগার। পাঠাগার এমন এক প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে জীবনের ও সমাজের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পাঠ নেওয়া সম্ভব। যেহেতু রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকে সমাজের ব্যাপকতাকে স্পর্শ করতে হয়, তাই লাইব্রেরিমুখী না হলে যে-কোনো ব্যক্তির পক্ষে সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। পাঠাগার ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে দাতা ও গ্রহীতার। লাইব্রেরি থেকে ইনপুট নিয়ে আউটপুট দিতে হবে রাজনীতির বিরাট জমিনে। তবেই একটি সফল, সুন্দর ও উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির ভূমিকা বর্তমানে সবচেয়ে প্রবল। আর তাই, রাজনীতির কারবার এখন জ্ঞানীদের বিচরণভূমি। কাজেই রাজনীতির কর্মী ও নেতাকে, জ্ঞানে ও বোধে, অন্যান্য নাগরিকের তুলনায় এগিয়ে থাকতে হয়। রাজনীতির লোকেরা সাধারণ হয়েও অসাধারণ। রাজনীতির মাঠ এমন এক জায়গা, যেখানে মানুষকে সর্বোতভাবে নিবেদিত হতে হয়। এখানে গ্রহণের আশার চেয়ে প্রদান আর ত্যাগের প্রত্যয় বেশি থাকা প্রয়োজন
পাঠাগারে কারা আসে? নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের সবচেয়ে অগ্রসর, আধুনিক ও রুচিশীল এবং বিদ্যানুরাগীর বিচরণে মুখরিত হয়ে ওঠে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণ। পরিবারের, সমাজের বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মেধাবী মানুষগুলো পাঠাগারকেন্দ্রিক নিজস্ব ভুবন তৈরি করে নেয়। একজন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতাকে আইন-মানবাধিকার-প্রশাসন-নিরাপত্তা, কৃষি-খাদ্য-অর্থনীতি-বাণিজ্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি, জলবায়ু, প্রযুক্তি — নানান বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখতে হয়। পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁর এই অধীত জ্ঞান বিশেষভাবে সহায়তা করে। কিন্তু কোনো পন্ডিত ব্যক্তি বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো সাধারণ মানুষ এতো বিপুল জ্ঞান আহরণ করতে পারে না— এই অনন্য সুযোগটি দিতে পারে কেবল পাঠাগার। বিচিত্র ধরনের বই, সাময়িকপত্র, বিশেষ প্রকাশনা প্রভৃতির সংগ্রহ থেকে মানুষ সহজেই তার দরকার অনুযায়ী তথ্য বা তত্ত্ব জেনে নিতে পারে। তাহলে, সহজেই অনুমান করা যায় যে, রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যত বেশি পাঠাগার-কেন্দ্রিক জ্ঞান-সাধনায় সম্পৃক্ত থাকবেন, দেশ ও জাতি তত বেশি প্রাগ্রসর সেবক পাবে। সেবাই যদি রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে কর্মীকে অবশ্যই ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ নানান বিষয়ে ধারণা নিতে হবে। রাজনীতির পরিচ্ছন্ন পাঠ গ্রহণ ও এর চর্চার ভেতর দিয়ে জাতিকে অগ্রগমণের পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব— যার ভিত তৈরি করে দিতে পারে একটি পাঠাগার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পাঠাগারের সাথে মানুষের সম্পর্ক। এই সুদীর্ঘকাল ধরে পাঠাগার মানুষকে জানানো এবং জাগানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তবে, পাঠাগারের আকৃতি, প্রকৃতি বদলেছে অনেক। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠাগার যে নতুন চরিত্র ধারণ করেছে, তারও তাৎপর্য কম নয়। আবার, কোথাও কোথাও পাঠাগার আড্ডার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে; কোথাও-বা পাঠচক্র কিংবা সাহিত্যসভার জন্যও পাঠাগার প্রধান পছন্দের জায়গা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যত বেশি পাঠাগার-কেন্দ্রিক জ্ঞান-সাধনায় সম্পৃক্ত থাকবেন, দেশ ও জাতি তত বেশি প্রাগ্রসর সেবক পাবে। সেবাই যদি রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে কর্মীকে অবশ্যই ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ নানান বিষয়ে ধারণা নিতে হবে। রাজনীতির পরিচ্ছন্ন পাঠ গ্রহণ ও এর চর্চার ভেতর দিয়ে জাতিকে অগ্রগমণের পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব— যার ভিত তৈরি করে দিতে পারে একটি পাঠাগার
বইপড়া কারো কাছে নেশা; কারো জন্য তা অবসর সময় কাটানোর উত্তম পন্থা। এই নেশা বা সময়-কাটানোর সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করাও সম্ভব। মানুষ নিশ্চয়ই ২৪ ঘন্টা রাজনীতি করে না; আর কেবল রাজনীতি কেন—কোনো পেশার লোককেই ২৪ ঘন্টা দায়িত্ব পালন করতে হয় না। ৮ ঘন্টা কাজ করলে দিনের বাকি সময়টা থেকে কিছু সময় বের করে প্রতিদিনের রুটিনে পাঠাগারের জন্য অন্তত ১-২ ঘন্টা সময় বরাদ্দ রাখা যেতেই পারে। এমনকি সমাজ ও রাজনৈতিক ধাপ এবং ধারা পরিবর্তনে অন্যান্য আন্দোলনের মতো পাঠাগার আন্দোলনও হতে পারে একটি প্রশস্ত ও বিশ্বস্ত মাধ্যম। এই ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রত্যয় বাস্তবায়নে অধিকতর উন্নত প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে। রাজনীতির মাঠে নিজেকে নিয়োজিত রাখার জন্য প্রকৃত প্রশিক্ষণ পাঠাগার থেকে লাভ করা যেতে পারে। সমাজ-পরিবর্তনের ধারা কিংবা পরিবর্তিত সমাজের রূপ ও প্রভাব বিষয়ে মত-বিনিময়ের যথার্থ স্থান হতে পারে পাড়ার লাইব্রেরি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পাঠাগার আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারলে জনমুখী রাজনীতির নতুন নতুন ধারা সৃষ্টি হবে। আর তাই, শহরে গ্রামে— সকল লোকালয়ে পাঠাগার স্থাপন অগ্রসর চিন্তার চিহ্ন বহন করে। প্রসঙ্গত, প্রমথ চৌধুরীর ‘বইপড়া’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে— ‘বই পড়া শখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাইনে। ’বাস্তবিকই পাঠ্যাভ্যাসকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা আমাদের সকলের কর্তব্য। আমরা জানি, মানুষ প্রবঞ্চনা করলেও বই কখনো কাওকে ঠকায় না। বই পড়ার আনন্দ প্রকৃতির মতো নির্মল। পাঠাগারের কারবারে কোনো অংশীদার বা উত্তরাধিকার থাকে না— এখানে পুরো অর্জনটাই ব্যক্তিগত। এই ব্যক্তিগত অর্জনকে আশ্রয় করে যদি কেউ রাজনৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে, তাহলে তার সেই সাধনার পথ হবে নিষ্কণ্টক এবং কল্যাণময়। অন্যদিকে, পাঠাভ্যাস মনকে প্রসারিত করে; তখন মানুষ হতাশার কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারে। বর্তমান সমাজে অবসাদ-ভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে, বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা ও ঝুঁকি। এসব নেতিবাচক চিন্তার মূলে রয়েছে জ্ঞানবিমুখতা তথা পাঠাগার থেকে দূরে থাকার মতো বাস্তব পরিস্থিতি। মানুষই যদি না বাঁচে, ব্যক্তি যদি বিপন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে রাজনীতি কার জন্য? অতএব মানুষের কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অবশ্যই রাজনীতির সাথে পাঠাগার এবং পাঠাভ্যাসকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
প্রতিটি রেজিস্ট্রার্ড রাজনৈতিক দলে একজন পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক রাখা যেতে পারে; এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ উপ-কমিটিও কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিটি প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক অঞ্চলে সুসজ্জিত ও পরিকল্পিত পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে যথাযথ চিন্তার পথে সামিল রাখা যায়। আগ্রহী কোনো ব্যক্তির রাজনীতির প্রথম পাঠ বা হাতেখড়ি হতে পারে বাড়ির কাছের একটি পাঠাগার থেকে। পাঠাগার হতে পারে সকলের চিন্তার পথ-প্রদর্শক। পাঠাগার হোক রাজনীতির প্রথম পাঠশালা।