
শক্তিশালী দেশগুলোর নির্লিপ্ততায় ফিকে জলবায়ু সম্মেলন
- পরিবেশ
- নভেম্বর ১৮, ২০২৪
আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত এবারের জলবায়ু সম্মেলনে মূল দাবি ছিল—যে ধনী দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বিশ্বকে উত্তপ্ত করেছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে, জলবায়ু রাজনীতি বরাবরই জটিল ও স্বার্থান্বেষী। এতে জড়িয়ে রয়েছে দেশীয়-আঞ্চলিক কৌশল, ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং ঐতিহাসিক দায়মুক্তির অজুহাত। পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাবও স্পষ্ট। জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
ফলে প্রশ্ন উঠছে—জলবায়ু সম্মেলন কি ক্রমেই দুর্বল দেশগুলোর মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে? যদি তাই হয়, তবে এর দায় কি বিশ্বশক্তির কাঁধে নয়? বাকু সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন শক্তিশালী দেশের শীর্ষ নেতা। অংশ নেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা দেশটির পরিবেশমন্ত্রীও। ভারতের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছেন পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং। এতে সম্মেলনের গুরুত্ব ও প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের বিষয় হলো, বর্তমান কপ প্রক্রিয়া দ্রুত পরিবর্তন আনতে সক্ষম নয়, কিংবা দেশগুলোকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করার সামর্থ্য রাখে না। গত বছর দুবাইতে অনুষ্ঠিত কপ২৮ সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসার বিষয়ে একমত হয়। অথচ সম্মেলনের এক বছর পর দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্যাসগুলোর নিঃসরণ প্রায় ১ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে জলবায়ু সম্মেলনে বেসরকারি কোম্পানির আনাগোনা একেবারে নতুন নয়। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো বেশ ক’টি কোম্পানি স্পন্সর হিসেবে হাজির হয়েছিল। তবে বাকুতে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির উপস্থিতি এতটাই সরব যে, তা দরিদ্র-অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিদের সন্দেহ-উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
প্যারিস চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ফরাসি কূটনীতিক লরেন্স টুবিয়ানা এখন ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের সিইও। তিনি বলেন, ‘বহুপক্ষীয় আলোচলা হলো জলবায়ু সমস্যা সমাধানের ভিত্তি। প্যারিস চুক্তি সম্ভব হয়েছিল, কারণ প্রতিটি দেশ একেকটি কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। সংস্কার প্রক্রিয়াটি শক্তিশালী করতে হবে, নয়তো এর সমঝোতা তৈরির ক্ষমতা ও বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল স্টিল বলেন, মিটিগেশন অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ কমানোর পেছনে পয়সা দেওয়ার ব্যাপারেই পশ্চিমা দেশের আগ্রহ বেশি। তা হলেই পশ্চিমা দেশের বেসরকারি খাত ব্যবসা পাবে। আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন উসুতু কামারা। তিনি বলেন, জলোচ্ছ্বাস এবং সাইক্লোনে আমার দেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু অবকাঠামো এবং খোদ রাজধানী শহর চরম হুমকিতে পড়লেও এসব রক্ষার কাজে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে তেমন টাকা পাচ্ছি না। বরং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে কাজ আমাদের করতে হয়েছে।
বিশ্বে জলবায়ু দূষণের অন্যতম কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন। এই গ্যাস নির্গমনে সবচেয়ে কম ভূমিকা রাখা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলা ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে রূপান্তরে বার্ষিক ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি চাওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের পক্ষ থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয়, তার থেকে ১০ গুণ সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু অর্থায়নের ধরন ও অর্থ কে দেবে এবং কত অর্থ দেওয়া হবে– এসবের মধ্যেই আলোচনা আটকে আছে। বাকুতে আলোচকরা নতুন জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কপ সম্মেলনের অর্ধেক পথে এসে সবাই এখন এ বিষয়ে সজাগ।