শেয়ারবাজারের গভীরতা

শেয়ারবাজারের গভীরতা

শেয়ারবাজার কখনো অর্থনীতির আগে চলে, কখনো পেছনে। এটা নির্ভর করে অর্থনীতির অন্য উপাদানগুলোর ওপর। শেয়ারবাজার অর্থনীতির আগে চলে যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একটা উঠতি আশাবাদের সৃষ্টি হয়।

আর পেছনে পড়ে যখন অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা ফেরত আসে। তবে শেয়ারবাজারকে অংশগ্রহণমূলক বা এই বাজারকে পুঁজি সংগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বানাতে হলে যেমন ভালো রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করাতে হয়, তেমনি ভালো প্রডাক্টসের জোগান দিতে হয়।

বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিদের আমরা পুঁজি নিয়ে বেশি অর্থ আয় করার সুযোগ করে দিতে পারিনি। আজও অধিকাংশ উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোক সরকারের সঞ্চয়পত্র কিনে বা জমিসহ অন্য সম্পদ কিনে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ খাটাচ্ছে

শুধু ইক্যুইটি বা কমন স্টক (Common stock) নির্ভর শেয়ারবাজার (যেমন বাংলাদেশের শেয়ারবাজার) অতটা বড় হয় না এবং এ ধরনের বাজারের প্রতি সম্ভাব্য ও সক্ষম বিনিয়োগকারীরা সবসময় লক্ষ্যও রাখে না। তারা বিনিয়োগের জন্য সুদসহ অন্যান্য হাতিয়ার খোঁজে। শেয়ারবাজার আবার গণমানুষের বাজারও নয়। শিক্ষিত, ভালো আর্থিক সামর্থ্যরে লোকদের জন্য এই বাজার।

বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিদের আমরা পুঁজি নিয়ে বেশি অর্থ আয় করার সুযোগ করে দিতে পারিনি। আজও অধিকাংশ উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোক সরকারের সঞ্চয়পত্র কিনে বা জমিসহ অন্য সম্পদ কিনে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ খাটাচ্ছে।

সরাসরি শিল্প পুঁজিতে এই শ্রেণির লোকদের অর্থ খুব কমই ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে শেয়ারবাজারকে পুঁজি সংগ্রহের জন্য এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তদের সঞ্চয়কে বিনিয়োগের অন্যতম পছন্দের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। এর মূল কারণ হলো ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় পুঁজির জোগান দিত। সরাসরি মানুষের কাছ থেকেও যে পুঁজি নেয়া যায়, তা তাদের ধারণায় তেমন ছিল না। ফলে ব্যবসায়িক ও শিল্প পুঁজির প্রায় একচেটিয়া উৎস হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংকগুলো। এর ফলে অর্থনীতি সুদনির্ভর হয়ে পড়ল, লোকে সুদ আয়কে আয়ের বড় উৎস মনে করতে লাগল। আর এজন্যই সুদের হার কমলে তারা মনে কষ্ট পেত।

আমরা যে শেয়ারবাজারকে গড়ে তুলতে অনেক সময় নিলাম, সেটা ছিল আমাদের উপলব্ধির অভাব, বিশেষ করে যাদের পলিসি সাপোর্ট দেয়ার কথা তাদের অমনোযোগিতা, ক্ষেত্রবিশেষে অজ্ঞতাও

শেয়ারবাজারকে অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অবদান খুবই সামান্য। পরবর্তী সময়ে তারা বাণিজ্যিক ব্যাংক স্থাপন করতে যত উৎসাহ বা আগ্রহ দেখায়, তার সিকিভাগও শেয়ারবাজারকে বড় ও অংশগ্রহণমূলক করতে দেখায়নি। তবুও আমাদের মতো কিছু লোক শেয়ারবাজারকে শিল্প ও ব্যবসায়িক পুঁজির জন্য এর গভীরতা এবং এতে সুশাসনের কথা সবসময় বলে আসছিল। বস্তুত এর মূলে আমাদের অর্থনীতির জ্ঞান কাজ করছিল। বাজার অর্থনীতিতে পুঁজি জোগানের জন্যও একটি বাজার থাকে, যা হলো শেয়ারবাজার। এ বাজার ব্যবহার করে পশ্চিমের দেশগুলো বহু আগেই অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল।

আমরা বহুদিন ধরে নিম্নস্তরের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি নিয়ে পড়ে রইলাম। মানুষকে পুঁজি নিয়ে বেশি আয় করার সুযোগ থেকে দূরে রাখলাম। আমরা যে শেয়ারবাজারকে গড়ে তুলতে অনেক সময় নিলাম, সেটা ছিল আমাদের উপলব্ধির অভাব, বিশেষ করে যাদের পলিসি সাপোর্ট দেয়ার কথা তাদের অমনোযোগিতা, ক্ষেত্রবিশেষে অজ্ঞতাও।

বাজার অর্থনীতি চালু করলাম, অথচ শেয়ারবাজারকে গড়ে তুললাম না, এটা হলো এক ধরনের অজ্ঞতা থেকে ঘোড়ার আগে গাড়ি স্থাপনের মতো। আমাদের ব্যবসায়ী মহলের অনেকেও ব্যাংকঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়ে সম্পদ করত। ফলে অর্থনীতি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে একটা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হলো বটে; তবে তা পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য আদায় এবং কর ফাঁকিসহ অন্যান্য আইন লঙ্ঘনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

এদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেছে বটে; তবে তাদের উদ্দেশ্যটা সৎ ছিল না। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শেয়ারবাজারে লিস্টিং দিয়ে উচ্চমূল্যে বা ম্যানুপুলেটেড মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে আরো বড়লোক হওয়া। তাই দেখা যায়, আজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যত কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে, সেগুলোর কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ ‘জেড’ (Z) ক্যাটাগরিতে স্থান লাভ করাসহ দেউলিয়া কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

আজ যে সমাজে প্রকট আয় বৈষম্য হচ্ছে, তা মূলত সম্পদ ধারণের বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। যতদিন আমরা শিল্প ও ব্যবসায়িক লাভের একটা অংশকে শেয়ার ধারণের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের হাতে পৌঁছে দিতে না পারব, ততদিন সমতাভিত্তিক বা সমান সুযোগের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করার বিষয়টি অলীক কল্পনাই থেকে যাবে

এর ফলে যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওইসব খুদে বিনিয়োগকারী, যারা বিশ্বাস করে এসব ঠকবাজ উদ্যোক্তাদের শেয়ার কিনেছে। অন্য যে কারণে আমার মতো লোকেরা শেয়ারবাজারের পক্ষে কথা বলত তা হলো, আপনি যদি অর্থনীতিতে সঞ্চয় বাড়াতে চান এবং সঞ্চয়কে বিনিয়োগে পরিণত করতে চান তাহলে একটা বর্ধিষ্ণু শেয়ারবাজারের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক।

এজন্য এক কথায় ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করার একটা সুযোগ ধনী ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের জন্য করে দিতে হবে, যাতে করে এই বাজারের মাধ্যমে পুঁজি শিল্প ও ব্যবসায় আসতে পারে। আমাদের মতো লোক আরেকটি কারণেও একটি অংশগ্রহণমূলক শেয়ারবাজার চায়। সেটা হলো অ্যাসেট বা সম্পদ ধারণের ক্ষেত্রে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সুযোগ করে দেয়া।

আজ যে সমাজে প্রকট আয় বৈষম্য হচ্ছে, তা মূলত সম্পদ ধারণের বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। যতদিন আমরা শিল্প ও ব্যবসায়িক লাভের একটা অংশকে শেয়ার ধারণের সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের হাতে পৌঁছে দিতে না পারব, ততদিন সমতাভিত্তিক বা সমান সুযোগের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করার বিষয়টি অলীক কল্পনাই থেকে যাবে।

আমাদের বাজার অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে সম্পদের মালিকানা ধারণের মাধ্যমে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টিকে আমলে নিতে হবে। যারা শুধু আয়ের সমবণ্টনের কথা বলেন, কিন্তু শেয়ার ধারণের মাধ্যমে আয় প্রবাহের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেন, তারা ভুলের মধ্যে আছেন। সম্পদের মালিকানা বিস্তৃত হলে ভোগ বাড়বে। ভোগ বাড়লে অর্থনীতি এগোনোর শক্তি পাবে।

তবে আমাদের শেয়ারবাজারই অর্থনীতির আকারের তুলনায় অনেক ছোট। এর কারণ হলো আমরা একে বড় ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যথেষ্ট নীতি-সহায়তা দিইনি। এত ছোট বাজারে বেশি অর্থ প্রবেশ করিয়ে শুধু মূল্যকে উপরে পুশ করলে সেটা টেকসই হবে না। বিগত এক দশকে সরকার অনেকবার বলেছে, সরকারি মালিকানার কোম্পানিগুলো থেকে আরো কিছু শেয়ার বিক্রি করা হবে। কিন্তু নিরেট সত্য হলো, সরকার একটি শেয়ারও বিক্রি করেনি বা করতে পারেনি।

যারা কু-যুক্তি দেখিয়ে এ কাজে বাধা দিয়েছে, তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। সরকারও শেয়ার বিক্রি থেকে শত শত কোটি টাকা পেত, সেটাও পায়নি। অনেক দেশের উঠতি শেয়ারবাজার সমৃদ্ধ হয়েছে সরকারি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। আমাদের দেশে গ্লাস ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে তার কোম্পানি, হোটেল ব্যবসা এখনো সরকারের পূর্ণ মালিকানায় চলছে।

অনেক পুঁজি খাটিয়ে এসব সরকারি বাণিজ্যিক (নামে মাত্র) প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার কোনো লাভ বা মুনাফাই পাচ্ছে না। কিন্তু সম্পদের পাশাপাশি অদক্ষ বা অপব্যবহারের দিকে নীতিনির্ধারকদের নজর নেই বললেই চলে। কিছু সরকারি লোক আছেন যারা এসব কথিত বাণিজ্যিক স্থাপনাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছেন। অথচ সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো হতে পারত শেয়ারবাজারে ভালো শেয়ার জোগানদানের উৎস।

আরো দুঃখের বিষয় হলো, সরকারি ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার কারণে একসময়ের স্টার বা তারকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন লোকসানে পতিত হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ ওসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লি., ন্যাশনাল টিউবস লি. ইত্যাদি। অথচ এসব শিল্প-কারখানা থেকে সময়মতো শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মেজরিটি শেয়ার অফলোড করলে সরকার যেমন শত শত কোটি টাকা পেত, অন্যদিকে ৪৯ শতাংশ বা তার কম শেয়ার ধারণ করেও বড় অংকের ডিভিডেন্ড পেত। আর বর্তমান অবস্থা হলো, এখন এসব শিল্প থেকে সরকার কিছুই পাচ্ছে না, উল্টো ভর্তুকি দিয়ে এগুলোকে চালাতে হচ্ছে।

অন্য ইস্যু হলো, আমাদের শেয়ারবাজারের গভীরতা এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করার জন্য উচিত ছিল দেশে বড় ব্যবসা করছে এমন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসা। কিন্তু সত্য হলো, এ ব্যাপারে গত ১০ বছরে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। মাত্র ১০ শতাংশ ইক্যুইটি বা মূলধন অফলোড বা গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে জনগণের কাছে বিক্রি করে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এমন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারে। তালিকাভুক্ত হলে তারা তাদের নিট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কম ট্যাক্স দেয়ারও সুবিধা পাবে।

তবুও বাস্তবতা হলো, তারা শেয়ারবাজারমুখী হতে ইচ্ছুক নয়। এর কারণ কী? কারণ একটাই, তা হলো আমাদের সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তাদের শেয়ারবাজারে আসার প্রয়োজনটাকে জোর দিয়ে তুলে ধরা হয়নি।

 

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়তে পারেন

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে নতুন করে আরও প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা…
জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

ঈদুল আজহার আগেই বাজারে ছাড়া হচ্ছে নতুন ডিজাইনের টাকার নোট, যা দুই টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত…
পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

সৌদি আরব হজ পারমিট সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যারা বৈধ…