
সংস্কৃতি বিদগ্ধ রুচির সুশীল মানুষ তৈরি করে
- নিবন্ধ
- নভেম্বর ১১, ২০২৪
জন্ম নিলেই তো মানুষ হয় না। অনেক চেষ্টায় অনেক সাধনায় মানুষ হয়ে উঠতে হয়। সেজন্য সংস্কৃতির খুব প্রয়োজন। সংস্কৃতিই মানুষকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করে। সংস্কৃতিই মানুষকে সামাজিক জীবে পরিণত করে। মূল্যবোধ-আদর্শ-সুস্থ জীবনবোধ-মন-মানসিকতা-চিন্তা-ভাবনার অধিকারি হতে হলে সংস্কৃতির কোন বিকল্প নেই। সংস্কৃতিই মানুষকে বিদগ্ধ রুচির মানুষে পরিণত করতে পারে।
আবার সাংস্কৃতিক পরিবেশ যদি সুস্থ না হয়, অপ-সংস্কৃতি যদি সমাজ জীবনে চেপে বসে তাহলে সমাজ কলুষিত হয়ে ওঠে, অশুভ চিন্তার মানুষের জন্ম হয়। সুস্থধারার সমাজ জীবনে তখন অসুস্থতা এসে ভর করে। একটা আদর্শ সাংস্কৃতিক সমাজ গড়ে ওঠার জন্য ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, ধারণা ধর্ম ও বিশ্বাস, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, অভ্যাস, সামাজিক মূল্যবোধ, উৎসব-পার্বণ এগুলো অপরিহার্য। আর এগুলো মিলেই তো গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বাতাসের প্রয়োজন অপরিহার্য, অথচ এই বাতাসকে কিন্তু দেখা যায় না। অনুভব করা যায়। সংস্কৃতির ভূমিকাও বাতাসের অনুরূপ। সংস্কৃতি ছাড়া কখনোই মূল্যবোধ সম্পন্ন বিদগ্ধ রুচির মানুষের গরে ওঠা সম্ভব নয়। দূষিত বাতাসে যেমন বাঁচা কঠিন, বসবাস করা অসহনীয়, তেমনি অপসংস্কৃতিতে মান-সম্মান, মূল্যবোধ-সুস্থ চিন্তাভাবনা ধারণ করে রুচিবোধসম্পন্ন সুশীল মানুষে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। সংস্কৃতির কারণেই চিন্তা-ভাবনা-মন-মানবিকতা-মূল্যবোধে পরিণত হয়ে ওঠে মানুষ।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সংস্কৃতি ধারণার সূত্রপাত হলেও আধুনিকভাবে এর ব্যবহার মাত্র কয়েক দশক আগে। বাংলায় সংস্কৃতি ব্যবহার শত শত বছর পূর্বে হলেও, পাশ্চাত্যে এর ব্যবহার চালু হয়েছে বহু আগে থেকেই। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা থেকে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা উচ্চতর এটা স্বীকার্য হলেও, প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতি থেকে বর্তমান ইউরোপীয় সংস্কৃতি কিন্তু উচ্চমার্গের নয়। গ্রিক মহাকবি হোমারের সময়কালের যুদ্ধসামগ্রী আর বর্তমান যুদ্ধসামগ্রী এক নয়। বর্তমানের যুদ্ধসামগ্রী বহুগুণে উন্নত ও অত্যাধুনিক। আবার প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ থেকে ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’ যে শ্রেষ্ঠ তা গ্রহণযোগ্য নয়। এরিস্টটলের ‘পলিটিকস’এর সাথে লাস্কির ‘এ গ্রামার অব পলিটিকস’ তুলনা করলেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। মূলকথা, সংস্কৃতির একটি উৎস থাকে —সেই উৎস থেকে সংস্কৃতি বিভিন্নরূপে বিবর্তিত হয়।
এককথায় সংস্কৃতি স্থিতিশীল কোন বিষয় নয়— গতিশীল। পাশ্চাত্যে সংস্কৃতি ‘কালচার’ হিসেবে ব্যবহৃত, বাংলায় সেটা ‘কৃষ্টি’ ও ‘উৎকর্ষ’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পাশ্চাত্যে ‘কালচার’ যে অর্থে ব্যবহৃত হতো, সেই একই অর্থে বাংলায় ‘কৃষ্টি’ ও ‘উৎকর্ষ’ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘কালচার’-এর পরিভাষা হিসেবেই শব্দ দু’টিকেই গ্রহণ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে ‘কৃষ্টি’র পরিবর্তে ‘উৎকৃষ্টি’র ব্যবহার অধিক যৌক্তিক মনে করেছেন এবং পত্র-পত্রিকায় এটা নিয়ে লেখালেখিও করেছেন। স্মরণযোগ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু তখন সংস্কৃতির ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দেননি। তিনি ইংরেজি ‘কালচার’ শব্দটির ‘পরিভাষা’ করেছিলেন মাত্র। তবে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি বর্তমানে যে ব্যাপক ব্যবহৃত—এতে রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কৃষ্টি’র পরিবর্তে যখন ‘উৎকৃষ্টি’ ব্যবহারের পক্ষে লিখছিলেন, সে-সময়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যবহারের জন্য রবীন্দ্রনাথের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের এ ব্যাপারটিকে গুরুত্বপূর্ণ মান্য করে ক্ষিতিমোহন সেনের মতামত গ্রহণ করেন। ক্ষিতিমোহন সেনের ইতিবাচক সম্মতি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যবহার শুরু করেন। এর পর শব্দটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। এতে ‘উৎকৃষ্টি’ শব্দটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উৎকৃষ্টি শব্দের মধ্যে যে সীমাবদ্ধ গণ্ডি ছিল, তা বিশালতায় রূপ নেয় সংস্কৃতি শব্দের মধ্যে। সংস্কৃতি শব্দের বহুল ব্যবহারে ‘কৃষ্টি’, ‘কর্ষণ’ ও ‘উৎকর্ষ’—এ শব্দগুলো বর্তমানে সেভাবে ব্যবহার হয় না। অনেকে এ শব্দগুলোকে সংস্কৃতি শব্দের সমার্থক কিংবা কাছাকাছি হিসেবে মনে করেন। আসলে
সংস্কৃতি শব্দের সঙ্গে এ শব্দগুলোর অনেক পার্থক্য। এসব দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। সহজভাবে দেখলে ব্যাপারটি দাঁড়ায়— বাঙালি সংস্কৃতি বলতে ‘বাঙালিয়ানা’। এই বাঙালিয়ানার ভেতর আছে, আমাদের যাপিত জীবনের সরলতা। এর কারণ বহুবিধ। বাংলাদেশের জন্মসূত্রের মূলে গ্রোথিত আছে দীর্ঘ সময়কালে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শাসকের ভূমিকা ও তাদের ভিন্ন ভিন্ন রুচিবোধ। ফলে এদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশ কখনো সমান্তরাল পথে ঘটেনি। শাসন-শোষণের নানা পর্বে গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে সময়ের দাবিকে গুরুত্ব দিয়েই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটেছে। সে কারণে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বহুমিশ্রিতি বহুরূপী চিত্র পরিলক্ষিত হয়। মূলত এই ‘বহুরূপী’ রূপটিই বাঙালি সংস্কৃতিতে সৌন্দর্যের আভারূপে ফুটে উঠেছে। নানা জাতি ও নানা বর্ণের সংমিশ্রণেই বাঙালি
সংস্কৃতি অভিনব এক বৈশিষ্টের অধিকারী হতে পেরেছে। এখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র সব মিলেমিশে একাত্ম হয়ে উঠেছে। এই একাত্ম সম্মিলিত স্বরূপটি ধরে রাখার ক্ষেত্রেও বাঙালির বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আছে। কারণ এই একাত্ম মিলনমেলায় বহুভাবে বহুবার রাজনৈতিক আক্রমণ ঘটেছে। রাজনৈতিক স্বার্থে একটি জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু সংস্কৃতির শক্তি এতোটাই যে, এই বিভক্তির পরেও বাংলাদেশের বাঙালি ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এদের মৌলিক পরিচয় এক এবং অক্ষুণ্ণ রয়েছে—আমরা বাঙালি। রাষ্ট্রিয়ভাবে বাঙালিকে পৃথক করা সম্ভব হলেও, বহুকালের ভাষিক বন্ধনের যে শক্তিমত্তা তা ছিন্ন করা বা খণ্ডন করা সম্ভব নয়। বাংলা ভাষার প্রাণের যে শক্তি, সেই শক্তিতে—সেই ভাষিকতায় বাঙালি একই সত্তা ও সূত্রে গাঁথা।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাজনীতিতে বাঙালি
সংস্কৃতি সবসময় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের চিন্তা-চেতনা-মন-মননে সংস্কৃতির ব্যাপারটা রক্তকোষের মতো যুক্ত। এটিকে বাদ দিয়ে সুস্থাধারার শিক্ষা ও রাজনীতি চিন্তা করা যায় না। বাঙালির হাজার বছরের যে সংস্কৃতি প্রবহমান নদীর মতো বহমান, তা থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটলে রক্তক্ষরণের মতো যন্ত্রণা অনুভূত হয়। বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির যে বিশ্বায়ন, সেখানে ভিন দেশি সংস্কৃতি অনায়াসে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভেতর ঢুকে পড়ছে। সেসব সংস্কৃতির প্রতি বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নেশাগ্রস্তের মতো আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। একই দেশে শিক্ষা-ব্যবস্থা বিভিন্নমুখী হওয়ার কারণে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিনির্ভর আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেখানেও বিদেশি ভাষা সংস্কৃতির নগ্ন দখলদারিত্ব শক্তভাবে ঘটছে। তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিজের দেশ নয়, বিদেশ। ফলে তারা নিজ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-ভাষার প্রতি গুরুত্ব হারিয়ে বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। যে কারণে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাশিক্ষার শত শত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সেদিকেই বর্তমান প্রজন্মের আকর্ষণ বেশি। এর কারণও স্পষ্ট এদেশের তরুণ সমাজ বর্তমানে নিজের দেশে ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্ন লালন করে না। যে কারণে তাদের মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি-দেশপ্রেম গড়ে উঠতে পারছে না। আমাদের বাংলা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনালালিত ও কাঙ্ক্ষিত যে দেশ, তার সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। শিক্ষা ব্যবস্থায় নানারকম অব্যবস্থাপনা, উন্নত কারিকুলামের অভাব, গবেষণার ঘাটতি ও গুরুত্বহীনতা, বিদেশি ভাষাপ্রীতি—শিক্ষকসমাজের ক্ষমতাপ্রীতি ও অর্থপ্রীতি-দুর্নীতি ও অসততা—তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বড় ধরণের হতাশা তৈরি করেছে। রাজনীতি যখন দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির না হয়ে ব্যক্তিক লোভ-লালসা-হীনস্বার্থ উদ্ধারের পন্থা হয়ে ওঠে, তখন সেই রাজনীতিতে দেশের কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে না, রাজনীতি যখন শুধু ক্ষমতায় আরোহনের সিঁড়ি হিসেবে নির্ণিত ও বিবেচিত হয় তখন স্বাভাবিকভাবে দেশের স্বপ্ন হতাশার কালো অন্ধকারে পরিণত হয় তা অস্বীকার করা কঠিন। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র এবং হাজার বছরের ঐতিহ্য সুন্দর আগামীর যে পথ নির্মাণ করবে বলে এতো ত্যাগ-তিতিক্ষা তা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। যা সত্যিকার অর্থে গভীর বেদনাবোধের সঞ্চার করে। অথচ একসময় এদেশের মানুষ এদেশটাকেই নিজের স্বপ্নের দেশ হিসেবে স্বপ্ন দেখেছে। এ দেশটার জন্য জীবন দিয়েছে। এই দেশে জন্ম এই দেশেই মৃত্যু কামনা করেছে। কিন্তু বর্তমানে এ স্বপ্ন দূরাশা হয়ে উঠেছে। নিজের ভাষার প্রতি অবহেলা, নিজের দেশের নামে দুর্নাম বদনাম। দেশটাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব না নিয়ে পলায়নবৃত্ত কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরা এদেশে সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলছে, আর হাজার মাইল দূরে বেগমপাড়ায় রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করছে। এই যে ভয়াবহ অবক্ষয়-লুটতরাজ-এ থেকে মুক্তির পথ কোথায়! কতদূরে! এ প্রশ্ন তো এখন স্বাভাবিক। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিক্ষা ভয়াবহ অবক্ষয়ের ঝড়ে কবলিত। শেকড়হীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের উত্তর প্রজন্ম। মূল্যবোধ যে শব্দটি বাঙালির চরিত্রে অপরিহার্য ছিল, সেই মূল্যবোধ ব্যাপারটিই এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। খাদ্যে বিষ, শিক্ষায় বিষ, চিকিৎসায় বিষ, চেতনায় বিষ, রাজনীতিতে বিষ, সবক্ষেত্রে তীব্রতর বিষাক্ত পরিবেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সোনার বাংলার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। দেশে এত এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসাকেন্দ্র, শিল্প-কলকারখানা এবং উন্নয়ন ঘটছে, অথচ একটা বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে দেশটাকে অবক্ষয়ের অতলে নিয়ে যেতে তৎপর, তারা সবকিছুতে বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই চরম সর্বনাশা থেকে মুক্তি ঘটানো খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে একটা সময় এমন হবে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে, আমাদের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা হারিয়ে যাবে, ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধের চেতনালালিত রাজনীতি হারিয়ে যাবে। ভয়াবহ অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে ফেলবে।
এক্ষেত্রে বাঙালির সরলতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এই সরলতাকে ব্যবহার করে একশ্রেণির মানুষ পুঁজিপতি হয়েছে, লুটেরা হয়েছে, খুনি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুও সরলতার মূল্য দিয়েছেন মহামূল্যবান জীবন দিয়ে। সরলতার কারণে এদেশে বিভিন্ন সময়ে বিশাল জনগোষ্ঠী অভাব-অনটন-বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়েছে। অতীত ইতিহাসের দিকে যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে বাংলা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। কৃষি, বনজ, তাঁতশিল্প, মৎস্য—এসবে সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই বৈজ্ঞানিক, তারা প্রকৃতি থেকে প্রচুর পরিমাণে যে সম্পদ উৎপাদন করতো, তাতে তাদের দারিদ্র্যের জীবন হওয়ার কথা ছিল না। বিভিন্ন শাসনকগোষ্ঠী এদেশে এসেছে, লুটতরাজ করেছে, নিজেরা ভোগ-বিলাসে মত্ত থেকেছে। এদেশের সরল মানুষেরা সম্পদ উৎপাদনের মূল শক্তি হয়েও নিজেদের উৎপাদিত পণ্য নিজেরা ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দরিদ্রতা ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে। অত্যাচারী শাসকেরা এদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস স্থাপন করে আর্য-অনার্য, বড়লোক-ছোটলোক, উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ, সম্মানী লোক-অসম্মানী লোক এভাবে বিভাজন করেছে। আর নিজেদের বিত্তবান ও সম্মানিত মানুষ হিসেবে সমাজে-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করে সাধারণ জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত শক্তিকে ভেঙে ক্ষীণ করে শক্তিহীন করেছে। এই বিত্তবান ও শাসকের সবাই ভিনদেশী নয়, বাঙালিও ছিলেন। এই বাঙালি শাসকেরাও বাঙালিয়ানার অংশ। তাহলে শাসক-শোষক-ধনী-গরিব-অন্ত্যজ শ্রেণি সব মিলেই তো ‘বাঙালিয়ানা
সংস্কৃতি’ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কার, আচার-আচরণ, যাপিতজীবন, সমাজ-সমকাল-আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা এবং জীবনাচারের জন্য যা কিছু আছে, তার সবই সংস্কৃতি। আর শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-সঙ্গীত-নৃত্য—এসবের ভেতর মানসিক প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এটা হলো মানস-সংস্কৃতি। বাঙালির সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য একেবারেই নিজস্ব। বাংলায় যে সব শাসকগোষ্ঠী শাসন করেছে, তাদের সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ ছিল। তুর্কি-আরব-ইরান ও মধ্য-এশিয়ার সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্যে মিশ্রিত একটা রূপ ছিল। এদের অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান বাংলার সংস্কৃতিতে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাতে খাঁটি বাঙালিত্বেও ঘাটতি ঘটছে। অপসংস্কৃতি এসে প্রবলভাবে দখলদারিত্ব করছে। ফলে হৃদয়ক্ষরণ হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রক্ত-কান্না-লাশ সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশে সুস্থ সংস্কৃতিধারা ক্রমশ যে নিজস্বতা হারাতে বসেছে তা অত্যন্ত বেদনার। অনেকে মনে করেন, আমরা তো উন্নতি করছি। কিন্তু গভীরভাবে কেউ অনুধাবন করছেন না—আমাদের ভাষা-সাহিত্য সংস্কৃতিকে ভিনদেশি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি গ্রাস করে নিচ্ছে শক্তভাবেই। বাঙালি সংস্কৃতি যে তার স্বরূপ হারাতে বসেছে, আমরা নিজেদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি রক্ষার্থে সচেতন না হলে, ভবিষ্যতে বাঙালি সংস্কৃতি ভিনদেশি সংস্কৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাবে, সে আশঙ্কা বোধহয় খুব বেশি অমূলক হবে না।
বাঙালির সংস্কৃতিকে যদি সময়কাল বিবেচনায় দেখি, তাহলে আঠার শতক পর্যন্ত ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। বৈষ্ণবসাহিত্য, ইসলাম ধর্মবিষয়ক রচনা ও অধ্যাত্ম-তত্ত্বাশ্রিত প্রণয়োপাখ্যান—এসব সেসময়ের সাহিত্য। সেই ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্যের ভেতরই কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। মানবিক এ উচ্চারণের ভেতর দিয়েই মানুষের মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে।
যার ফলে, একজন অবৈষ্ণবকবি লিখতে পেরেছেন রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ, অমুসলমান লেখক দাভুদ মিরবাঘেরি লিখতে পেরেছেন হাসান-হোসেনের মর্মন্তুদ-কাহিনি নিয়ে ‘কারবালা-কাহিনি’। বাঙালি সংস্কৃতির এই মানবিকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অবক্ষয়ের যে ভয়াল থাবা তীব্রগতিতে আমাদের উপর ধেয়ে আসছে, তা থেকে রক্ষার জন্য শিক্ষা-রাজনীতি-সংস্কৃতিতে মানবিকতা-দেশপ্রেম-ভাষাপ্রেম খুব বেশি প্রয়োজন।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক।
ডিন, কলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়।