
সমবায় কী, কেন করব সমবায়
- নিবন্ধ
- নভেম্বর ১৪, ২০২৩
ছোট বড় প্রায় সবাই সমবায়ের কথা জানে। অনেকেই জানে না আসলে সমবায় কী? সমবায় শব্দের অর্থ হচ্ছে —সম্মিলিত উদ্যোগে কোনো কিছু গড়ে তোলার চেষ্টা। ছোট করে বলা যায়, যৌথ কর্ম প্রচেষ্টাই সমবায়। সহজ কথায় সমবায় হলো সবাই মিলেমিশে কাজ করা। আর সমবায় সমিতি হচ্ছে এমন একটা সংগঠন, যা নিজেদের ব্যবসা ও সমাজের উন্নয়নের জন্য পরিচালনা করা হয়। যারা সমবায় করে, সমবায় সমিতির সদস্য হয়, তাদের বলে সমবায়ী। সমবায়ীরা নিজেদের প্রয়োজনেই সমবায় সমিতি গঠন করে। কী সেই প্রয়োজন? উন্নতির প্রয়োজন। সমবায় করে একই সঙ্গে দুই ধরনের উন্নতি হয়। অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক উন্নতি। সমবায়ীর ব্যক্তিগত মুনাফা বা লাভের সুবিধা অর্জনই আর্থিক উন্নতি। আর্থিক সুবিধা সমবায়ী যতটুকু হাতে পায় তাকে বলে লভ্যাংশ। সমবায় সমিতির একজন সদস্য ব্যক্তিগত মালিকানা হিসেবে যে পরিমাণ শেয়ার সমিতিতে জমা করে সে অনুপাতে সে লভ্যাংশ পায়। যার শেয়ারের পরিমাণ বেশি থাকে, সে বেশি লভ্যাংশ পেয়ে থাকে। কম শেয়ারের মালিক-সদস্য কম লভ্যাংশ পায়। এটা সমবায়ে সাম্য নীতি। এতে কোনো হেরফের নেই। সমবায়ে সব সদস্যই সমান। বয়সের কম বেশির জন্য কোনো ব্যতিক্রম নেই। নারী বা পুরুষের জন্য কোনো আলাদা নিয়ম নেই। অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে সদস্যদের অবস্থার উন্নয়ন হয়।
সমবায় সমিতি করে সবাই সম্মিলিতভাবে যে সুবিধা উপভোগ করে, তা-ই সামাজিক উন্নতি। কোনো সমবায় সমিতির সদস্যরা যখন একতাবদ্ধ হয়ে গ্রামের ভাঙা সড়ক মেরামত করে, তখন রাস্তায় চলাচলের সুবিধা সবাই পায়। সমবায় সমিতির মাধ্যমে গ্রামে কোনো স্কুল বা নলকূপ যখন চালু করা হয়, তখন তার উপকার সবাই পায়। এটাই সামাজিক উন্নতি। এর ফলে সমবায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অবস্থানের উন্নয়ন হয়। সমগ্র সমাজেরই উন্নয়ন হয়।
এখন কথা হলো উন্নয়ন কী? উন্নয়ন হচ্ছে পরিবর্তন। পরিবর্তনের ফলে কোনো কিছু বেশি হলেই উন্নতি হয় না। নদ-নদীতে বা মাঠে বিলে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি বলে না, অবনতি বলে। বন্যা বৃদ্ধি পেলে রাস্তাঘাট ডুবে যায়, যোগাযোগ বিছিন্ন হয়, ফসলের ক্ষতি হয়। আরও অনেক ক্ষতিকর কিছু ঘটে। আবার বন্যার জল কমে গেলে পথঘাট জেগে ওঠে। যোগাযোগ চালু হয়। তাই বন্যার পানি কমে যাওয়াকে বলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি। মূল কথা মন্দ বা ক্ষতিকর পরিবর্তনকে উন্নতি বলে না। ভালো বা কল্যাণকর পরিবর্তনকে উন্নয়ন বলে। এ উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো সমবায়। সৎ উদ্দেশ্যে নিজেদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য একতাবদ্ধ মানুষের যৌথ উদ্যোগে কাজ করাকেই সমবায় বলে।
সমবায়ীরাও পিঁপড়ার স্বভাবী। সবাই মিলে অনেক বড় কাজ করে। অসম্ভবকে সম্ভব করে। সদস্যদের গরিব অবস্থা দিনে দিনে দূর করে স্বচ্ছলতা এনে দেয় সমবায়। তাই সমবায় হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের অনন্য হাতিয়ার। অভাবের যুদ্ধে জেতার হাতিয়ার
সমবায়ের নিয়ম কানুনও আইনসম্মত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমবায় কর্মকাণ্ড চলে। সমবায় সমিতির কাজ পরিচালনার জন্য একটি কমিটি বা পরিষদ থাকে। এর নাম ম্যানেজিং কমিটি বা ব্যবস্থাপনা পরিষদ। সাধারণ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে কমিটির নির্বাচন হয়। কোনো বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য যে সিদ্ধান্তে একমত হয়, সেই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয়। আবার সাধারণ সদস্য, যারা ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নয়; তারাও নিজ নিজ মতামত দিতে পারে সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায়। সাধারণ সভায় যে বিষয়ে বেশিরভাগ সদস্য একমত হয়, সেটাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং কার্যকর করা হয়। আদতে সমবায়ের লেনদেন, কাজকর্ম সবকিছুই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং আইন মোতাবেক চলে। সমবায় গণতন্ত্র চর্চার এক অন্যতম সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। মৈত্রী ও সম্প্র্রীতির সংগঠন সমবায়। সমবায়ে কোনো জাতিগত বিদ্বেষ নেই। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নেই। বর্ণ-বৈষম্য ও পেশাগত পার্থক্য নেই। সমবায়ের নিয়ম মেনে সবাইকে সামর্থ্যানুযায়ী নিয়মিতভাবে প্রতিমাসে সঞ্চয় জমা দিতে হয়। এতে দিনে দিনে অনেক সঞ্চয় জড়ো হয়ে বড় পুঁজি গড়ে ওঠে। সঞ্চয়ের ওপর লাভও পাওয়া যায়। এভাবে পুঁজি আরও বেড়ে যায়। তাই সমবায় স্বয়ং সঞ্চয় ও সম্পদ বৃদ্ধির কারিগর। সমবায় বিত্তহীনকে বিত্তের সন্ধান দেয়। গরিবকে ধনী হওয়ার পথ দেখায়। সমবায়ে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আপন। কেউ কারও পর নয়। কবি কামিনী রায় বলেছেন —‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’—একথা সমবায়ের জন্য শতভাগ সত্য।
সমবায়ে কেউ কাউকে শোষণ করে না। সবাই সবার সহমর্মী, সমব্যথী। সমবায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা হলেও, শেয়ার সঞ্চয়ের মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগও সফলতা অর্জন করে। আবার সবাইকে বাদ দিয়ে কেউ একজন একা বা স্বতন্ত্র হয়ে যেতে পারে না। তাই সমবায়ে পরস্পর সহযোগিতার মধ্য দিয়েই ব্যক্তিসদস্যের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। সবার জন্য মঙ্গলজনক সিদ্ধান্তে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করা হয়। এ ভাবেই প্রত্যেকের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব মিলেমিশে সবার সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। যে কাজ একা অসম্ভব, সে কাজ দশে মিলে সমবায়ের মাধ্যমে সহজেই করা সম্ভব হয়। একটা মৃত তেলাপোকা বা টিকটিকিকে একটা পিঁপড়া টেনে নিতে পারে না। কিন্তু কতিপয় পিঁপড়া একত্রিত হয়ে সেই তেলাপোকা বা টিকটিকিকে ঠিকই টেনে টেনে গর্তে নিয়ে শীতের দিনের জন্য খাদ্য হিসাবে সঞ্চয় করে রাখে। সমবায়ীরাও পিঁপড়ার স্বভাবী। সবাই মিলে অনেক বড় কাজ করে। অসম্ভবকে সম্ভব করে। সদস্যদের গরিব অবস্থা দিনে দিনে দূর করে স্বচ্ছলতা এনে দেয় সমবায়। তাই সমবায় হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের অনন্য হাতিয়ার। অভাবের যুদ্ধে জেতার হাতিয়ার।
সাধারণত সবল যে, দুর্বলকে সে জুলুম করে; শোষণ করে। সমবায়ে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে সংগঠন। তাই সেখানে দুর্বলের ওপর সবলের কোনো অন্যায় চলে না। সবার মধ্যে একই শৃঙ্খলা কাজ করে। সমবায়ে অলস সম্পদ হয়ে ওঠে উৎপাদনের শক্তিশালী উপকরণ। একজন স্বচ্ছল সদস্য তার অব্যবহৃত অর্থসম্পদ বাক্সে ফেলে না রেখে, সমিতিতে সঞ্চয় করলে সেই সঞ্চয়ের ওপর মুনাফার সুবিধা পায়। আর ওই সঞ্চয়-আমানত থেকে অন্য সদস্যরা স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা বা উৎপাদনে কাজে লাগায়। কাজেই সমবায় হচ্ছে ‘সম্পদ বৃদ্ধির শোষণহীন প্রতিষ্ঠান। বেকারের আত্মকর্মসংস্থানের সন্ধানদাতা। গরিবের স্বনির্ভর হওয়ার সহযোগিতার আড়ালে নিজেকেই সহায়তা করা। শুধু নিজেকে নিজে সাহায্য করলে সফলতা নাও আসতে পারে। আর সমবায় পদ্ধতিতে নিজের সাহায্য অন্যের মাধ্যমে ফিরে এলে সাফল্য নিশ্চিত হয়। তাই বলা যায় —দশের লাঠি একের বোঝা, সমবায় বুঝতে সোজা।
সমবায়ে কেউ কাউকে শোষণ করে না। সবাই সবার সহমর্মী, সমব্যথী। সমবায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা হলেও, শেয়ার সঞ্চয়ের মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগও সফলতা অর্জন করে। আবার সবাইকে বাদ দিয়ে কেউ একজন একা বা স্বতন্ত্র হয়ে যেতে পারে না। তাই সমবায়ে পরস্পর সহযোগিতার মধ্য দিয়েই ব্যক্তিসদস্যের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে
সমবায় কর্মকাণ্ডে নীরবে নীরবে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে। একটু স্বচ্ছল সদস্য সমিতিতে যে শেয়ার ও সঞ্চয় আমানত করে, তা সমিতির নিজস্ব পুঁজি বা মূলধন। যে সদস্য একটু বেশি অস্বচ্ছল, সে সমিতির ফান্ড বা তহবিল থেকে ঋণ নেয়। সমবায়ে ঋণের সুদও কম। আবার এ সুদটাই তো সমিতির লাভ। বছর শেষে সেই লাভের একটা অংশ অর্থাৎ লভ্যাংশ প্রত্যেক সদস্যই পায়। এভাবে লভ্যাংশ পেয়ে এবং স্বল্প সুদের সহজ ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে অভাবী সদস্য দিনে দিনে স্বচ্ছল হয়। তার আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। ফলে সমিতির সদস্যদের মধ্যে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমে যায়। সমাজে মানুষে মানুষে বৈষম্য দিনে দিনে দূর হয়ে যায়। সমবায়ের এ উপযোগিতা বাংলাদেশে আরও বেশি বাস্তব ও দৃশ্যমান। বাংলাদেশে গরিব লোকের সংখ্যা বেশি। নিরক্ষর লোকও অনেক। অশিক্ষিত-আধাশিক্ষিত লোকের সংখ্যাও বেশি। বেকার নর-নারীর সংখ্যাও সমাজের অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যাগুলো সমবায় করে অল্প দিনে সহজেই দূর করা সম্ভব। কেননা বিন্দু বিন্দু জল মিলে যেমন মহাসাগর হয়; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা মিলে যেমন মহাদেশ হয়; তেমনি সমবায় সমিতির সদস্যদের মাসিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় মিলে বড় পুঁজি গড়ে ওঠে। সেই পুঁজি দিয়ে বড় ব্যবসা বা অন্য কোনো উৎপাদনে কাজে লাগানো যায়।
মোদ্দাকথা নিজেদের পুঞ্জিভূত অর্থসম্পদ, সমবেত শ্রমসম্পদ ও সম্মিলিত ইচ্ছাসম্পদ কাজে লাগিয়ে অব্যর্থ সফলতা অর্জনের সংগঠন হচ্ছে সমবায়। দারিদ্র্যের দুরারোগ্য ব্যাধির কবল থেকে রেহাই পেতে সমবায় আমাদের জন্য মহৌষধ। আমরা সমবায় করব। আমরা দারিদ্র্য হটাব। সম্পদ সৃষ্টি করব, আত্মকর্মসংস্থান করব; উৎপাদন বাড়াব। এক সমবায় করেই সব কাজ একই সঙ্গে করব। সমবায় করলে সব হয় —একতা, সততা, সম্প্র্রীতি, সমঝোতা, গণতন্ত্র, নেতৃত্ব সব কিছু। সমবায়ই শক্তি, সমবায়ই মুক্তি। আমরা সমবায় করব; নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ব।
লেখক: কবি, গবেষক ও সাবেক উপসচিব, বিসিএস সমবায় ক্যাডার।