প্রকৃতিতে প্রাণের পূর্ণতা

প্রকৃতিতে প্রাণের পূর্ণতা

প্রকৃতি আমাদের বাসস্থান। সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রকৃতির ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেই এ পর্যন্ত পৃথিবীর জীবকুল বেঁচে আছে। কিন্তু কতবছর এই নিশ্চিন্তে বসবাস চলবে, তা এখন ভাবনার বিষয়। যেহেতু পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে আমাদের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই পরিবেশ যত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অর্থনীতিতে তা ততটাই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রকৃতির সাথে রয়েছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। প্রকৃতির সাথে সমন্বয় ঘটিয়েই মূলত উন্নয়ন কর্মকান্ড ত্বরান্বিত হয়।

আমরা জানি, বর্তমান প্রাকৃতিক পৃথিবী আর আগের অবস্থায় নেই। মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে সবুজ পৃথিবী এখন হুমকির মুখে। যত্রতত্র প্লাস্টিকের ব্যবহার, খেলার মাঠ ও খোলা জায়গা জবর দখল, নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবাভরাট, শিল্প কারখানার বর্জ্য ফেলে পানিদূষণ, বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতিরিক্ত শিল্প-কারখানা, দালান-কোঠা, শপিং মল বৃদ্ধি সবুজ পরিবেশকে ধূসর করে তুলছে। এছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন—বন্যা, খরা, ভূমিধস ও ভূমিক্ষয়, টর্নেডো, মৌসুমি ঝড়, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি। আর এসব কিছুর সাথে অর্থনৈতিক উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রয়োজন টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যা সরাসরি প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত। প্রকৃতির কাছ থেকে যে সম্পদ ও সেবা আমরা চাইছি, তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার মাধ্যমেই পৃথিবীর স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। তার জন্য প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি প্রাকৃতিক স্থিতিশীলতা। সুপরিকল্পিতভাবে প্রকৃতি ও অর্থনীতির মাঝে সমন্বয় ঘটিয়েই এর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে যা সারা পৃথিবীর জন্য সুফল বয়ে আনবে।

মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে সবুজ পৃথিবী এখন হুমকির মুখে। যত্রতত্র প্লাস্টিকের ব্যবহার, খেলার মাঠ ও খোলা জায়গা জবর দখল, নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবাভরাট, শিল্প কারখানার বর্জ্য ফেলে পানিদূষণ, বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতিরিক্ত শিল্প-কারখানা, দালান-কোঠা, শপিং মল বৃদ্ধি সবুজ পরিবেশকে ধূসর করে তুলছে। এছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন—বন্যা, খরা, ভূমিধস ও ভূমিক্ষয়, টর্নেডো, মৌসুমি ঝড়, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি। আর এসব কিছুর সাথে অর্থনৈতিক উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে

প্রকৃতিই অর্থনীতির ধারক ও বাহক। প্রকৃতি ধ্বংস বা অবহেলিত হওয়া মানে অর্থনীতির ধ্বংস ডেকে আনা। যার মাধ্যমে অর্থনীতি অর্জন করবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি, তাই যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে জীবকুল হুমকির সম্মুখীন হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রকৃতির সাথে অর্থনীতির সমন্বয় ঘটাতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। প্রয়োজন সম্পদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাংঘর্ষিক অবস্থান পৃথিবীকে নিঃশেষ করে দেবে অচিরেই। মানুষের অবিমিশ্র চাওয়া, অতি আধুনিকতার ছোঁয়া, দূরদর্শিতার অভাব, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, অসচেতনতা— এ সবকিছুই প্রকৃতি ধ্বংসে মূল ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ বিপর্যয় ও সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ আরেকটি বড় সমস্যা।

পৃথিবীর শীর্ষ আট ধনীর কাছে পৃথিবীর মানুষের অর্ধেক সম্পত্তি, যা ভাবতেও অবাক লাগে। ধনীদের সম্পদ বাড়ার ক্রমবর্ধমান হার এবং দরিদ্রের সম্পদ কমার হার দ্রুততর হচ্ছে। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট হয়ে উঠছে। এটা এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে, পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। একদল ধনী, অন্যদল দরিদ্র। মধ্যবর্তী শ্রেণি বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। এতে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এটা পৃথিবীর আসন্ন এক বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। বিশ্বনেতৃত্ব এর সমাধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। পৃথিবীর মোড়ল রাষ্ট্রগুলো ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমানোর উদ্যোগ সেইভাবে নিচ্ছে না। সংস্কার সাধন ও সংশোধনকামী দেশ ও নেতৃত্ব নেই। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট বিপর্যয় বিশ্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার গতি ত্বরান্বিত করছে।

বর্তমানে ভয়াবহ দাবানল, বন্যা, খরা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস বেড়েই চলেছে। প্রকৃতি যেন নীরব প্রতিশোধ নিচ্ছে। যেই প্রকৃতি আমাদের ধারণ ও লালনপালন করে, সেই প্রকৃতির প্রতি আমাদের এই ধ্বংসাত্মক মনোভাব এটি মাথা পেতে নেবে না, নিচ্ছেও না। তাই প্রকৃতি ফুঁসে উঠছে। পরিবেশের অতিরিক্ত ৯০ শতাংশ তাপ শোষণ করে সাগর-মহাসাগরগুলো। ফলে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে ঝড়ঝঞ্জা বেড়েছে। আবার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সাগরের তলদেশে প্রাণী মারা যাচ্ছে। জাপান ও ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি এবং আমেরিকার উপকূলে উপর্যুপরি টর্নেডো ভবিষ্যতে আরো বড় বিপর্যয়ের আভাস দিচ্ছে।

পরিবেশবাদিরা বলছেন, অরণ্য বিধ্বংসী, জীববৈচিত্র্য বিনষ্টকারী এরূপ দাবানল অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর কার্বন নির্গমন কমানো যাবে না, সম্ভব হবে না পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধকরণ। ফলে উষ্ণতা চিরতরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে পড়বে। অর্থনীতিতে টানপোড়েন সৃষ্টি হবে

মানুষের সৃষ্ট অনাচারে বিশ্বপ্রাণিকুলের অবস্থা আরো বেশি সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ছে। গত চার দশকে বিশ্বে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৬০ শতাংশ কমেছে। দূষণ, বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, মাছ, সরীসৃপজাতীয় প্রাণী ও উভচর প্রাণীর প্রজাতি কমছে। স্বভাবগত স্থানান্তর, শিকার, দূষণ, রোগব্যাধি ও জলবায়ু পরিবর্তন ক্রমাগত বাড়ছে। মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি এমন জায়গা কমে যাচ্ছে। যে হারে মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বন্যপ্রাণী রক্ষা করা যাবে না।

প্রকৃতি বিনষ্টে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা দুনিয়াতেই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তারমধ্যে আমাজন জঙ্গলে সংঘটিত দাবানল বিশ্ববাসীর জন্য সন্ত্রস্ত্র হওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত এই বিশাল অরণ্য কেবলই পুড়ছে। আমাজন পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে আর পৃথিবীর কার্বন শুষে নেয় ২৫ শতাংশ। এই আমাজনে রয়েছে ১৬ হাজার প্রজাতির ৪ লক্ষাধিক উদ্ভিদ, আড়াই লক্ষ পতঙ্গ। ভয়াবহ এই সকল দাবানলে নানাবিধ প্রাকৃতিক সম্পদ ও আবহাওয়ার ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়ে চলেছে। এতে অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট গবেষণা বলছে, আমাজনের এমন অগ্নিকান্ডের জন্য বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক কারণ মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি সব মানুষের দ্বারা সংঘটিত। চাষাবাদ, বসতি স্থাপন, খনিজ আহরণ, শিল্প স্থাপন ও অন্যান্য জীবিকাধর্মী কর্মকান্ড চালনার জন্য মানুষ বৃক্ষ নিধন করছে, জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমাজনের বনভূমি উজাড় হচ্ছে— বিনষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকার পশ্চিম উপকূল ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তৃত অঞ্চলে বছরে ছোট-বড় অসংখ্য দাবানলের ঘটনা ঘটছে। গাছপালা, ঘরবাড়ি, ভূমিসহ বিভিন্ন ক্ষতিও সেক্ষেত্রে বিরাট হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ও তাসমানিয়া অঞ্চলেও শতাধিক মারাত্মক দাবানলের ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপেও বহু অগ্নিকান্ড বা দাবানল হয়েছে এরই মধ্যে। পরিবেশবাদিরা বলছেন, অরণ্য বিধ্বংসী, জীববৈচিত্র্য বিনষ্টকারী এরূপ দাবানল অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর কার্বন নির্গমন কমানো যাবে না, সম্ভব হবে না পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধকরণ। ফলে উষ্ণতা চিরতরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে পড়বে। অর্থনীতিতে টানপোড়েন সৃষ্টি হবে।

দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর গড় উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরফ গলছে অস্বাভাবিক হারে পৃথিবীর উত্তরাংশে, এমনকি হিমালয় পর্বতমালার বরফও গলে যাচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। দাবানল বা অগ্নিকান্ডের ভয়াবহ ঘটনাবলি ছাড়াও পৃথিবীজুড়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বেড়েছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় বন্যায় মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে; খাদ্য সংকটে পড়ছে। চীনের এবারের বন্যার ক্ষয়ক্ষতিও অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ব্যাপক। এদিকে বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতা ও সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতাও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এমনিতেই বঙ্গোপসাগর খুবই উষ্ণ এক সাগর। এই সাগর অববাহিকার দেশগুলো যেমন— বাংলাদেশ ও ভারতে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিকট অতীতের সিডর, আইলা, বুলবুল, আম্পানের ধ্বংসযজ্ঞ এ অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে।

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন, যা সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসাবে ঘোষিত। আগে এর আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। এখনো বাঘ, হরিণ, ভোঁদড়, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল এই সুন্দরবন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে এই সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের নিকটবর্তী অঞ্চলে। ফলে বনাঞ্চলটির ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে কার্বন, ছাই, গ্যাস, বর্জ্য, কয়লাসহ ভারী ধাতুর প্রভাবে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার এলাকায় পরিবেশগত সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এর ফলে বনটির গাছপালা ধীরে ধীরে মারা পড়বে, ভূমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে।

বছরে আমরা অবিশ্বাস্য হারে বন্যপ্রাণী নিধন করেছি। আমাদের কাছে এখনো প্রকৃতির ধ্বংস ঠেকানোর ক্ষমতা আছে; অথচ একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা আদিম সমাজের চেয়ে বেশি সংখ্যক বন্যপ্রাণী শিকার করছি। আমরা মনে করছি, প্রকৃতি শুধু উদারহস্তে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তার জন্য প্রকৃতিকে যে সংরক্ষণ করতে হবে, সে চিন্তা অধিকাংশ মানুষের মাথাতে নেই।

পশু, পাখি ও মাছ খাবার গ্রহণের সময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। সমুদ্রের তলদেশে টন টন পলিথিন জমা হচ্ছে। এতে করে পানি দূষিত হয়ে মারা যাচ্ছে মাছ ও সমুদ্রের বিভিন্ন প্রাণী এবং উদ্ভিদ। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্লাস্টিক ঢুকে পড়ছে। পাখি ও সামুদ্রিক মাছ ভক্ষণের মাধ্যমে মানুষের দেহে এই ভয়াবহ ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক-জাতীয় পদার্থ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন শুধু ঢাকা শহরে এক কোটির বেশি পলিথিন পরিত্যক্ত হচ্ছে। এভাবে সারা দেশে পলিথিন এখন উচ্চ হারে ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন ছড়িয়ে পড়ছে পুকুর, ডোবা-নালা ও নদীতে। পশু-পাখি ও মাছের পেটে ঢুকছে এসব পলিথিন। এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে মানুষ। অসুখ-বিসুখে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে মানুষ।

সম্পদের সুষম বন্টন, প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়ী বন্দোবস্ত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার ছাড়া পৃথিবীকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বলা যায়, অবহেলিত কৃষিকে শিল্প ও সেবার সাথে সুষম ও সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কৃষি বিপ্লব ছাড়া শুধু শিল্প ও সেবার কথা ভাবা অবান্তর। টেকসই কৃষি মানে প্রাকৃতিক কৃষি, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার পানি, কৃষি জমিকে ধ্বংস করছে। আমরা যা খাই তার ৮০ ভাগ কৃষিপণ্য থেকে আসে। পানি প্রকৃতির প্রধান উপাদান। সুতরাং পানি ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নও প্রকৃতি সুরক্ষা করবে। পানি মানে ভূ-উপরিভাগ, ভূগর্ভ ও বৃষ্টির পানি। ভূ-উপরিভাগের সব পানিতেই মাছসহ নানারকম জীব বাস করে। পানি পুষ্টির অন্যতম প্রধান উপাদান মাছেরও বিচরণক্ষেত্র এবং মানুষের ২০ভাগ প্রোটিন মাছ থেকে পাওয়া যায়। পানি দূষিত হওয়া মানে মাছসহ পানি নির্ভর জীবের বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।

সবুজ অর্থনীতি, সবুজ বিনিয়োগ এবং সবুজ ব্যাংকিং একটি সময়োপযোগী এবং সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। আরো আছে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, সবুজ দালান নির্মাণ, টেকসই পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা, সুষ্ঠু পানি, ভূমি ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনাকে পরিকল্পিত উপায়ে বাস্তবায়ন করা। টেকসই জ্বালানি মানে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। এক্ষেত্রে পানি ও বায়ুনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত এবং কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে

টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীর অপব্যবহার রোধ করতে হবে। নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। টেকসই উন্নয়ন ও নদী রক্ষায় সবাইকে নিয়েই সামনে এগোতে হবে। নদীর ব্যবহার এখন বহুমাত্রিক। মানুষ বুঝে না বুঝে নদীকে ব্যবহার করছে। নদীর কাছেই গড়ে উঠেছে বড় বড় কল-কারখানা, নদীতে এখন হাজার হাজার লঞ্চ স্টিমার। নদীতে শত শত বাঁধ। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবেই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে নদীগুলো ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তন করছে। ফলে বাংলাদেশে চর জেগে ওঠা জমি একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে এবং চাষযোগ্য জমি ক্রমশ কমছে। ছোট এই দেশের মধ্যে দিয়ে ছোট-বড় অসংখ্য নদী বয়ে গেছে। মানুষের পেশা, জীবনযাপন এবং সাহিত্য সংস্কৃতি সবকিছুই নদীর ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্ভরশীল। আমাদের দেশে নদীর কাছে যে জমি চাষ করা হয় তাতে ব্যবহার করা হয় নদীর পানি। উৎপাদিত ফসল শহরে নিয়ে যাওয়া হয় নদী পথে। নদী আমাদের সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। নদীর গুরুত্ব বোঝাটা তাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।

এছাড়া সবুজ অর্থনীতি, সবুজ বিনিয়োগ এবং সবুজ ব্যাংকিং একটি সময়োপযোগী এবং সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। আরো আছে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, সবুজ দালান নির্মাণ, টেকসই পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা, সুষ্ঠু পানি, ভূমি ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনাকে পরিকল্পিত উপায়ে বাস্তবায়ন করা। টেকসই জ্বালানি মানে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। এক্ষেত্রে পানি ও বায়ুনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত এবং কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়ন মানে প্রকৃতিবান্ধব শিল্পায়ন। প্রকৃতি সুরক্ষায় দেশের সব জলাশয়কে দখল ও দূষণের কবল থেকে রক্ষা ও পানিধারণ ক্ষমতা বাড়াতে ড্রেজিং করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সব রকম প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার পরিমিত করতে হবে। দেশজ যেমন— ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছ লাগাতে হবে। পলিথিন-প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার বর্জন এবং পাট-বাঁশ-বেতজাতীয় পণ্য ব্যবহারে মনোযোগী হতে হবে।

পৃথিবীর প্রাকৃতিক পুঁজি যেহেতু ফুরিয়ে আসছে তাই টেকসই উন্নয়ন এবং চিরস্থায়ী অর্থনীতিই মুক্তির পথ। এক্ষেত্রে সবুজ সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার। আর তার জন্য প্রয়োজন বায়ুমন্ডলে জমে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইডের অপসারণ। এছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, শিল্পায়ন এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থার মতো মৌলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাও একটা বড় বিষয়। যেকোনো ব্যাবসায়িক সংস্থার কৃতকর্মের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ ক্ষয়ক্ষতির জন্য সামাজিক চাপ ও রাষ্ট্রের আইন কঠোর হতে হবে। কার্বন কমানোর জন্য কার্বন কর ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যেতে পারে। ভবিষ্যৎ মজুরি ও কর্মসংস্থানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নতুন ধারণা তৈরি করতে পারে। কয়লা শিল্পকে বর্জন করে সৌর শিল্পের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। যেহেতু অর্থনীতিতে প্রকৃতি প্রচুর প্রভাব বিস্তার করে, তাই দূষণের লাগাম টেনে ধরা এখন সময়ের দাবি। পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নই আমাদের কাম্য। প্রকৃতির সর্বোচ্চ, সংরক্ষিত, সুরক্ষিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার সুনিশ্চিত করে, অর্থনীতিতে এর সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে এই দু’টির সার্থক মেলবন্ধনে আগামী পৃথিবী হোক নতুন প্রজন্মের সুরক্ষিত জীবনের চাবিকাঠি।

 

লেখক: পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

আরও পড়তে পারেন

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

নতুন আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে নতুন করে আরও প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা…
জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

জুনের প্রথম দিকেই আসছে নতুন নোট

ঈদুল আজহার আগেই বাজারে ছাড়া হচ্ছে নতুন ডিজাইনের টাকার নোট, যা দুই টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত…
পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

পারমিট ছাড়া হজ পালনে কঠোর ব্যবস্থা ঘোষণা সৌদি আরবের

সৌদি আরব হজ পারমিট সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যারা বৈধ…